মীলাদুন্নবী ও আধুনিক দেওবন্দিদের অবস্থান

মীলাদ সম্পর্কে একটা সময় মোটামুটি ভালো রকমের একটা প্রচারণা চলতো— কেবল এই উপমহাদেশের বাইরে আর কোথাও মীলাদ নাই। আমার এক বিশাল পড়ুয়া বন্ধু নামকরা এক আরব রিফাঈ শাইখ সম্পর্কে বলছিল, আরে উনি তো একদম এই উপমহাদেশীয় স্টাইলের মীলাদ পড়েন, উপমহাদেশের সূফীদের সাথে উনার কোন যোগাযোগ আছে নাকি! (হুবহু নয়, ওর কথার সারাংশ) যুগ বদলেছে। এখন মোটামুটি এতটুকু অনেকেই জেনেছেন যে, উপমহাদেশের বাইরে বরং মীলাদ মাহফিল আরো বেশি হয়। নজদী প্রভাবিত দুই-একটা রাষ্ট্র বাদ দিলে এমন কোন মুসলিম দেশ নাই, যেখানে মেহফিলে মীলাদ হয় না। বরং মাযহাবীদের মধ্যে মীলাদ নিয়ে এই ঝগড়াটাই কেবল উপমহাদেশে হয়ে থাকে। সত্যি বলতে কী, উপমহাদেশের “আধুনিক দেওবন্দী”দের বাদ দিলে চার মাযহাব ও আশয়ারি-মাতুরিদি-সূফি দাবিদার আর কোন ঘরানাই পাওয়া যায় না, যারা মিলাদ মাহফিলের বিরোধিতা করেন। বরং ব্যবহারিকভাবে নজদী চিন্তাধারার সাথে ট্র্যাডিশনাল চার ফিকহী মাযহাব ও দুই আকাইদী মাযহাবের অনুসারীদের মধ্যকার পার্থক্যসমূহের মধ্যে মীলাদকেও গণ্য করা হয়। ফলে যারাই নজদী-তাইমী ধারার বিরোধী, তাদের প্রায় সবাইই মাহফিলে মীলাদুন্নবীর পক্ষে। এমনকি আযহারী হাম্বলীরাও মাওলিদ পালন করেন। নজদী-তাইমী ঘরানার বিরোধিতার পাশাপাশি মাওলিদেরও বিরোধিতা করেন, এমন আজিব ধারা কেবল বোধ হয় “আধুনিক দেওবন্দী” ধারাই হয়ে থাকবে। তার কারণ– এসকল দেওবন্দীগণ নজদী-তাইমী ধারার বিরোধিতা করলেও বহু বিষয়ে তারা নিজেরাই ঐ ধারা কর্তৃক প্রভাবিত। বিদয়াতের সংজ্ঞা এমনই একটি বিষয়। যে কারণে এমন অনেক কিছু তাদের নিকট বিদয়াত মনে হয়, যা আসলে নজদী-তাইমী সংজ্ঞা অনুসারেই কেবল বিদয়াত হতে পারে। এখানেও ঝামেলা থেকে যায়। যেমন আমাদের শাইখ ওলিপুরী “ইল্লাল্লাহ” যিকিরের পক্ষে কথা বলেন, মীলাদের সমালোচনা করেন। অথচ নজদী সংজ্ঞানুসারে দুইটাই বিদয়াত হওয়ার কথা। শুনেছি মরহুম শাইখ পালনপুরী রাহিমাহুল্লাহ নাকি এই দুইটাকেই বিদয়াত বলতেন। আসলে আমার কাছে মনে হয়, দেওবন্দ কতখানি নজদী প্রভাবিত, এই প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর আসলে খোদ বর্তমান দেওবন্দও জানে কিনা সন্দেহ। আর সে কারণেই, আমার এমন অনেক কাওমী শাইখের সাথে দেখা হয়েছে যারা শাইখ ইবন আব্দিল ওহাবকে মুজাদ্দিদ মানেন, আবার ইমাম কাশমিরি-মাদানি রাহিমাহুমাল্লাহুর অনুসরণে শাইখ নজদির সমালোচনা করেন, এমন কাওমীদের সাথেও পরিচিত হয়েছি বিভিন্ন সময়ে। প্রশ্ন হলো, দেওবন্দ কি আসলেই মাওলিদকে বিদয়াত মনে করে? এখন দেওবন্দ তো কোন এক ব্যক্তির নাম নয় যে তার মত উল্লেখ করে বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করতে পারি। তবে দেওবন্দিদের সর্বজন স্বীকৃত বুযুর্গ আকাবির যারা ছিলেন, তারা কিন্তু মাওলিদ পালনের পক্ষেই ছিলেন। তারা যে পক্ষে ছিলেন, সেটা তাদের বহু কিতাব থেকে প্রমাণিত হলেও সাধারণত আধুনিক দেওবন্দীগণ সেসব লিখনীকে নানাভাবে তাওয়ীল করেন, কিংবা অস্বীকার করেন। তবে এ বছর দেখলাম মোটামুটি কেউ কেউ বিষয়টা স্বীকার করছেন। প্রথমেই শাইখ ইযহারুল ইসলাম এ বিষয়ে পোস্ট করেছিলেন, এবং তিনি যেহেতু তাইমী প্রভাবমুক্ত দেওবন্দী, ফলে তার এ পোস্ট নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নাই। সত্যি কথা বললে, দেওবন্দীদের মধ্যে নজদী-তাইমী প্রভাব না থাকলে সেই দেওবন্দীদের সাথে আমাদের আর বিরোধও থাকে না খুব একটা। দেওবন্দীদের সাথে আমাদের মতবিরোধ দেখা দেয় কেবল তখনই, যখন তারা হানাফী-মাতুরিদি-সূফী ঘরানার বিপরীতে নাজদী-তাইমী ঘরানা কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয় পড়েন। তবে কিছুদিন পূর্বে আরেকজন কাওমী শাইখের পোস্ট চোখে পড়লো, যিনি আসলে গড়ে দেওবন্দীরা যতটা তাইমী প্রভাবিত হয়ে থাকে আজকাল, তারচেয়ে অনেক বেশিই প্রভাবিত– সৌদি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুবাদে। তো সেই শাইখ মীযান হারুন সাহেবও দেখলাম স্বীকার করছেন যে– “মীলাদ মাহফিলের ক্ষেত্রে আকাবিরে দেওবন্দের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক। হযরত থানভী, গঙ্গুহীসহ দেওবন্দের শীর্ষস্থানীয় হাযারাতগণ মীলাদ মাহফিলকে শর্তসাপেক্ষে বৈধ বলেন। কেউ কেউ ‘মুস্তাহাব’ও বলেছেন।” এই কথাগুলো সাধারণত আমাদের হুজুরগণ মাহফিলে মীলাদুন্নবীতে বলে থাকেন। শাইখ মীযান হারুন এই কথাগুলোর পিঠে নিজের আরো কিছু কথা লাগিয়ে মাওলিদ-বিরোধিতা অব্যাহত রেখেছেন, এবং নজদী-তাইমী প্রভাবিত দেওবন্দী আলিমের নিকট থেকে এটা প্রত্যাশিতই বলা চলে। কিন্তু তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিতে হয় যে দেওবন্দের আকাবিরদের অবস্থানকে তিনি অন্যদের মতো বিকৃত করেননি। অবশ্য পরবর্তীতে আরো দুটি পোস্ট দিয়ে মীলাদ মাহফিলের বিরোধিতার বিষয়টিকে শক্তপোক্ত করতে কোন কসুর রাখেননি তিনি। শাইখ মীযান হারুনের নাম আসলো যখন, আরেকটি কথাও বলে ফেলি এই ফাঁকে। “ইয়া নবী সালামু আলাইকা” বললে শিরক হয়ে যায়, এমন ফতওয়া ছোটকালে বহু শুনেছিলাম, যা স্পষ্টতই নজদি ঘরানার ফতওয়া। (অনুপস্থিত কাউকে সম্বোধন করলে তাকে সর্বত্র উপস্থিত মনে করা হয়, তার মানে শিরক!!) আজকাল শিরকের বদলে বেয়াদবি হয় এমন ফতওয়া শুনি, যদিও শাইখুল হাদীস আযীযুল হক বুখারী শরীফের অনুবাদে এরকম সালাত-সালাম লিখেছিলেন। সে যাই হোক, এবারের মীলাদুন্নবীতে মীযান হারুন সাহেব দেখলাম “ইয়া নবী সালামু আলাইকা” পোস্ট করেছেন। অবশ্য তিনি এর আগেও এই সালামের বিরোধিতা করেছেন বলে চোখে পড়েনি। সে যাই হোক, এসব বিষয়ে আসলে আমাদের সময়ের “আধুনিক দেওবন্দিদের” সুনির্দিষ্ট অবস্থান যে কী, সেটা জানার আগ্রহ থেকেই যায়। কথা আর না বাড়িয়ে এখানেই শেষ কথাটা বলে ফেলি। নজদী তাইমি ঘরানার বাইরে, দেওবন্দ ছাড়া আর কোন ঘরানার আলিমগণ ইহতিফাল বিমাওলিদিন্নবীর বিরোধিতা করেন কিনা, একটু খোঁজ করে দেখবেন। আশা করি কাউকেই পাবেন না। ফলে আমাদের “আধুনিক দেওবন্দিদের” উচিত নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করা। তারা এই বিষয়ে আসলে মাযাহিবে আরবাআ ও আশাইরাদের সাথে আছেন, নাকি নজদী-তাইমী ঘরানাকেই অনুসরণীয় মনে করেন, এটা স্পষ্ট হয়ে গেলে আমাদেরও কথা বলতে সুবিধা হবে। [পুনশ্চ: মাওলিদ বৈধ নাকি বিদয়াত, সেটা এই পোস্টের আলোচ্য বিষয় নয়। এই পোস্টের মূল কথা হচ্ছে কারা মাওলিদকে বিদয়াত মনে করেন, আর কারা পালনীয় মনে করেন। ফলে আলোচ্য বিষয়ের বাইরে লম্বা চওড়া তর্কে যাওয়ার আগ্রহ আমার নাই। ধন্যবাদ]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *