দেশে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা তিন অঙ্ক ছুঁয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। প্রায়ই শোনা যায়, জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।
বর্তমানে যে হারে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে, সে হিসাবে কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা শতক অতিক্রম করলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না।
এ দেশে প্রথম যখন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী জোগান দেয়ার জন্য সারা দেশে পর্যাপ্তসংখ্যক মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল না।
এখন এই যে এতগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হল, এগুলো উপযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থী পাবে কিনা, সে চিন্তা না করেই আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতির স্বার্থে আরও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের স্বপ্ন দেখছি।
অথচ বাস্তবতা হল, আমাদের বেশিরভাগ উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীই ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার যোগ্যতা অর্জন না করেই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হয়ে থাকে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগ কোর্সই ইংরেজিতে পড়ানো হয়।
তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নের জন্য একজন শিক্ষার্থীর যে মানসিক পরিপক্বতা দরকার, তা আমাদের প্রচলিত শিক্ষা কাঠামো থেকে খুব কম শিক্ষার্থীই অর্জন করতে সক্ষম হয়। ফলে সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন যে রকম হওয়ার কথা, তার কিছুই হয় না, হওয়া সম্ভবও নয়।
আর তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত শিট মুখস্থ করে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার করে দেন। এরপর তাদের মধ্য থেকেই কেউ কেউ ভালো ফলাফল ও অন্যান্য যোগ্যতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে আবারও শিক্ষার্থীদের শিট মুখস্থ করাতে শুরু করেন। এভাবেই আবর্তিত হয় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা। সত্যিকারের বিদ্যাচর্চার পরিবেশ তৈরির কোনো প্রচেষ্টা ছাড়াই চলতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। গবেষণা তো অনেক দূরের বিষয়।
বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এসব সমস্যার সমাধান কি কেবল একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই হয়ে যাবে? কখনই না। যেখানে বর্তমানে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই উপযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থী পাচ্ছে না, সেখানে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে দেশের শিক্ষা কার্যক্রমে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে? সে সুযোগ কোথায়?
বিশ্ববিদ্যালকে সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করতে সবার আগে দরকার উপযুক্ত শিক্ষার্থী। উপযুক্ত শিক্ষার্থী আকাশ থেকে এসে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে না, বরং আমাদের প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকেই তাদেরকে বের করে আনতে হবে। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানোর আগে দরকার বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাব্যবস্থাকে যথার্থ করা। আমাদের দেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত যে পাঠ্যক্রম আছে, তা পুরোপুরি আয়ত্ত করতে পারলে একজন শিক্ষার্থীর শুধু বাংলাদেশ কেন, বিশ্বের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের উপযুক্ত হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে সক্ষম হওয়ার কথা।
কিন্তু বাস্তবতা হল, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এই পাঠ্যক্রমের এক-দশমাংশও আয়ত্ত করতে পারে না। এর পেছনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষকের অদক্ষতা যেমন দায়ী, তেমনি আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থাও দায়ী অনেকাংশে।
কাজেই পাঠ্যক্রম প্রণয়নের চেয়ে যথাযথরূপে পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নে কী কী পদক্ষেপ নেয়া দরকার, এ ব্যাপারে আরও বেশি গবেষণা হওয়া উচিত। আমার তো মনে হয়, যথাযথরূপে বাস্তবায়ন সম্ভব হলে বর্তমান পাঠ্যক্রমের অর্ধেক পড়াতে পারলেও সেটা শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট হবে।
কিন্তু এসব দিকে নজর না দিয়ে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাচর্চার চেয়ে বিদ্যা লয়ের সম্ভাবনাই বেশি, এবং আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা-ই হচ্ছে।