ক্ষমা করবেন কবি…

নিজের জন্ম তারিখটাও ঠিক মতো মনে রাখতে পারি না, ফররুখ আহমদেরটা তো অনেক দূরের কথা। সে হিসেবে যথারীতি ভুলে গিয়েছিলাম ফররুখের জন্মদিন। পত্র-পত্রিকায় ফররুখ সম্পর্কে নয়া-পুরনো নিবন্ধ ছাপা হচ্ছে দেখে বুঝলাম, কিছু একটা আছে। খোঁজ নিয়ে দেখালম, গতকাল ফররুখের জন্ম শতবার্ষিকী ছিল।

ফররুখ আহমদ

একেবারে নিঃশব্দে চলে যায় নি দিনটা, পত্রিকাগুলো কিছুটা হলেও প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছেপে দায় সেরেছে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবিদের একজন হিসেবে ফররুখের জন্ম শতবর্ষ যেভাবে উদযাপিত হওয়ার কথা ছিল, বলতে গেলে তার কিছুই হয় নি।
এর পিছনে নানা কারণ আছে। প্রথমত বেশির ভাগ বাঙালি বাংলা সাহিত্যে কবি বলতে চিনেন দুই জনকে, রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল। বন্দনা করতে হলেও এদের যে কোন এক জনের, কিংবা  ‍দুই জনেরই বন্দনা করেন, আবার ধুয়ে দিতে মন চাইলেও এদের কোন একজনকে ধুয়ে দেন। এই দুই জনের বাইরে বাংলা সাহিত্যে যে আরো কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ কবি আছেন, সেটা বেশির ভাগ বাঙালিই মেনে নিতে পারেন না। এই কারণটা আমাদের সামগ্রিক সাহিত্যবোধের হাল-হকিকতের বহিঃপ্রকাশ মাত্র, কাজেই এটা নিয়ে খুব বেশি কিছু বলার নাই।
এর বাইরে আরেকটি কারণে ফররুখ অবহেলিত হচ্ছেন বাংলা সাহিত্য পাড়ায়। এই কারণটাও আমাদের মানসিক দৈন্যদশার কথাই মনে করিয়ে দেয়। বর্তমান বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে যারা মূলধারা হিসেবে পরিচিত, তাদের সিংহভাগই ফররুখকে পাত্তা দিতে চান না তার আদর্শিক অবস্থানের জন্যে, কাব্যপ্রতিভার বিচার না করেই।
কবি তার আদর্শের প্রতি সৎ ছিলেন, কবিতায় সে আদর্শের অকপট বহিঃপ্রকাশ ঘটতো, এবং সেটা কোন রাষ্ট্রীয় কিংবা সামাজিক সুযোগ-সুবিধা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো না। দেশভাগের পর রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পাওয়ার জন্যে, কিংবা স্রোতে গা ভাসিয়ে, সে সময়ের বেশির ভাগ সাহিত্যিকই পাকিস্তানি ভাবধারার (!) কবিতা লিখতেন, সাহিত্য চর্চা করতেন, সেটা কোন অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতো না। বরং ফররুখই সে সময় পাকিস্তানের অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে কবিতা চর্চা করেছিলেন, ব্যঙ্গ কবিতা লিখে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে আত্মগোপন পর্যন্ত করেছিলেন।
ভাষা আন্দোলনের সময় তো বটেই, এমনকি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই কবি বাংলার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, উর্দুপন্থীদেরকে বিদ্রূপ করে বলেছিলেন যে তারা মুদ্রার লোভে বাংলাকে ছেড়ে উর্দুকে নিকা করেছেন! চরম আর্থিক সংকটে থাকা ফররুখ পাকিস্তানের লোভনীয় রাষ্ট্রীয় পদক বর্জন করেছিলেন, সেই পদকের সাথে ভালো রকমের অর্থ প্রাপ্তির সুযোগও স্বেচ্ছায় হারিয়েছিলেন। তবু তিনি পাকিস্তানপন্থী, তাই আমাদের সাহিত্যজীবীদের চোখে বর্জনীয়!
এতো কিছু বলার অর্থ হলো, ফররুখ কখনোই স্বার্থের কাছে তার আদর্শ বিকিয়ে দেন নি, স্বার্থোদ্ধারের জন্য আদর্শ কপচান নি। তবু ফররুখ অপাংক্তেয়, কারণ তিনি বাংলা সাহিত্যের রাজনৈতিক গতি পরিবর্তনের একটা পর্যায়ে পরিবর্তিত হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে পারেন নি, স্রোতের অনুকূলে সাতার কেটে সুবিধা আদায় করে নিতে পারেন নি, বরং নিজের বিশ্বাসের উপর অটল থেকেছেন, সৎ থেকেছেন। ফলে অনেকের কাছেই অপ্রিয় হয়েছেন, বাংলা সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ার পরও সাহিত্য আলোচনা থেকে তার নাম প্রায় মুছে গেছে বললেই চলে।
এখানেই সমসাময়িক অন্যদের সাথে তার পার্থক্য। অন্যরা স্রোত কোন দিকে যাচ্ছে সেটা বুঝে কখনো কায়েদে আজমের বন্দনা করেছেন, আবার কখনো বাঙালি জাতীয়তার একনিষ্ঠ সমর্থক সেজেছেন, ফররুখ সেখানে পাকিস্তানে বসে হায়াত দারাজ খান পাকিস্তানি ছদ্মনামে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেছেন, আবার বাংলাদেশে যখন সাহিত্যাঙ্গনে ইসলাম মহা পরিহার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে, তখনও ইসলামি কবিতা লিখেছেন, ইসলামি সাহিত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেছেন।
আমি নিজে ইসলামি ভাবধারায় বেড়ে উঠেছি বলে ফররুখ আমার যতটা প্রিয়, তার চেয়ে বেশি প্রিয় তার এই আদর্শিক সততার কারণে, যদিও আমি ফররুখ সাহিত্যের একনিষ্ঠ ভক্ত নই। বলতে দ্বিধা নেই, ফররুখের আরবি-ফারসি শব্দ তার কবিতায় যত শিল্পসম্মতই হোক না কেন, সেটা অনেকাংশেই অপ্রয়োজনীয় ছিল। বাংলা সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমি আবুল মনসুরকেই আদর্শ মানি, ফররুখ, এমনকি নজরুলও এক্ষেত্রে কিছুটা বাড়াবাড়ি করেছেন বলেই আমি মনে করি।
ফররুখ ইসলামি পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখতেন, ইসলামি কবিতা লিখতেন, এসব আমার কাছে ভালো লাগে ঠিকই, কিন্তু এসবই ফররুখ সম্পর্কে আমার পছন্দ-অপছন্দের মূল কারণ নয়। আমি ফররুখের যে জিনিসটার প্রতি সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধাশীল, সেটা হচ্ছে ফররুখের একগুয়েমি, তার নির্লোভ আদর্শবাদিতা। তিনি চাইলেই তার সময়ের ‘বড় কবিদের’ মতো মুখোশ পরিবর্তন করে নতুন চেতনা ধারণ করে অনেক সুযোগ-সুবিধা অর্জন করতে পারতেন, কিংবা পাকিস্তান আমলে শাসক গোষ্ঠীর অশেষ কৃপা হাসিল করতে পারতেন, কিন্তু এসব পরিহার করে তিনি যে দারিদ্র্যকে আপন করে নিয়েছিলেন, সেই দারিদ্র্যই আমার সবচেয়ে প্রিয়, সেই দারিদ্র্যই আমার কাছে সবচেয়ে ঈর্ষণীয়।
ফররুখের জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষে অনেক পূর্বপরিকল্পনাই ছিল, কিন্তু আলসেমি, বেখেয়ালি আর রোযা মাস কেন্দ্রিক ব্যস্ততার কারণে কিছুই হলো না। শেষ পর্যন্ত তাই মোবাইলের নোটপ্যাডে ইফতারপূর্ব আলসেমিতে শুয়ে শুয়ে নিজের অগোছালো অভিব্যক্তিটুকু লিখেই জন্ম শতবর্ষ পালন করতে হলো, তাও একদিন পরে। ক্ষমা করবেন কবি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *