প্রসঙ্গ ঈদ বানান : প্রতিবর্ণায়ন নিয়ে কতিপয় যুক্তি-অযুক্তি

EID

গত বছর ঈদের মৌসুমে হঠাৎ ঈদ বনাম ইদ তর্ক-বিতর্ক ফেসবুকে রীতিমত ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। এবার সেরকম ভাইরাল না হলেও ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে ঠিকই ঈদ বানান নিয়ে অনেকগুলো পোস্ট দেখলাম। সে হিসেবে আমারও কিছু বলার আছে বলে মনে হচ্ছে।
প্রথমত, আমি ঈদবানানের পক্ষে। তার কারণ প্রচলন। শুধু প্রচলন যে বানানরীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তার প্রমাণ খ্রিষ্টান। খ্রিষ্টান শব্দটি আর যাই হোক, তৎসম নয়। কিন্তু দেখতে তৎসমের মতো, এবং দিয়ে বানান প্রচলিত, এই দুই কারণে এ শব্দে থেকে গেছে। একইভাবে ঈদেও দীর্ঘ ঈ থেকে যেতে পারে, এবং আমি রেখে দেওয়ার পক্ষে।
এবার আসি, যারা ভাষাতাত্ত্বিক কথা-বার্তা বলছেন, তাদের কথায়। ঈদ শব্দের শুরুতে দীর্ঘস্বর আছে, এবং তার আগে যে ধ্বনিটি আছে, সেটি কণ্ঠনালীর মধ্যভাগ থেকে উচ্চারিত হয়। এই ধ্বনিটি বাংলায় হুবহু লেখার কোন উপায় নেই, এই চেষ্টা একেবারেই বৃথা। 
মাদ্দ বা দীর্ঘস্বরের  প্রতিবর্ণায়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘ ঈ বা দীর্ঘ ঊ ব্যবহার করতেই হবে যাদের মতে, তারা বাংলায় প্রতিবর্ণায়ন না করে সংস্কৃতে করলেই পারেন। কারণ, সংস্কৃতে দীর্ঘ আ, দীর্ঘ ঈ ও দীর্ঘ ঊ তিনটাই আছে, যা আরবি মাদ্দের তিনটি হরফ আলিফ, ওয়াও ও ইয়ার যথোপযুক্ত প্রতিবর্ণ হতে  পারে। বাংলায় দীর্ঘ আ নেই, আর দীর্ঘ ঈ ও ঊ নামে থাকলেও কাজে নেই। বাংলা উচ্চারণে দীর্ঘ ঈ আর হ্রস্ব ই একই রকম।
তবে হ্যাঁ, প্রতিবর্ণায়নের সুবিধার্থে কার্যত হ্রস্ব হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘ ঈ কে মাদ্দের জন্য বরাদ্দ করা যেতে পারে। কিন্তু এখানেও কথা আছে। বাংলায় যে সকল বিদেশি শব্দ লেখা হয়, সেগুলোকে মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়। এ ভাগ বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডারে এখনও সংযোজিত হয়নি, আরেক ভাগ হয়ে গেছে। সংযোজিত হয়নি, এমন শব্দের প্রতিবর্ণায়নে খেয়াল রাখতে হবে মূলের দিকে, এতে আমার কোন দ্বিমত নেই। যেমন ধরুন, কোন আরবি টেক্সট যখন বাংলায় প্রতিবর্ণায়ন করা হবে, তখন অবশ্যই মূল উচ্চারণের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে।
কিন্তু যেসকল শব্দ ইতিমধ্যে বাংলা শব্দ ভাণ্ডারের অংশ হয়ে গেছে সেগুলোর ক্ষেত্রে মূল ভাষায় কী রকম উচ্চারণ, সে চিন্তা না করাই ভালো। বরং বাংলা ভাষায় শব্দটি কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটাই লক্ষণীয় হওয়া উচিত। উদাহরণ স্বরূপ, “নবী/নবি” এই শব্দটা মূল আরবীতে হলো “নাবিয়্য্/নাবিয়্যুন”(نَبِيٌّ)। আপনি আরবি ভাষার নাম করে “নবী” লিখতে চাচ্ছেন, তাহলে ইয়ার উপরের তাশদীদ কী দোষ করলো? সেটার দিকে খেয়াল দিচ্ছেন না কেন? “নাবিয়্য্/নাবিয়্যুন” লিখছেন না কেন?  
জনাব, যেহেতু নবী/নবি শব্দটাকে আমরা আমাদের শব্দভাণ্ডারের অংশ বানিয়ে ফেলেছি, কাজেই এখন আর ইয়ার উপরের তাশদীদের দিকে খেয়াল না রাখলেও চলবে। আশা করি স্পষ্ট হয়েছে, মূল আরবির দিকে লক্ষ্য রেখে বানান করার ঝামেলাটা কোথায়? আরো সহজ ভাষায় বললে, যখন কোন আরবি টেক্সট প্রতিবর্ণায়ন করা হবে, সেখানে আরবি শব্দ নাবিয়্য্ আসবে, তখন ‘নাবিয়্য্’ই লেখা হবে, কিন্তু যখন বাংলা কোন টেক্সটের মাঝখানে নবি/নবী শব্দ ব্যবহৃত হবে, তখন মূল আরবির কথা না ভেবে এই শব্দটি বাংলায় যে রকম আছে, সেরকমই রাখতে হবে।
এখন আপনিই বলুন, ঈদ/ইদ শব্দটা কী বাংলা শব্দ ভাণ্ডারের অংশ হতে পেরেছে কি না? যদি পেরে থাকে, তাহলে এই শব্দের বানানে আর আরবির মূল বানান চিন্তার দরকার নেই, কেন নেই, আশা করি উপরের উদাহরণে স্পষ্ট হয়েছে।
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই, ঈদ বানানের জন্য আরবি বানানের দিকে লক্ষ্য রাখতেই হবে, তাহলে ঈদ কেন হবে? কেননা ঈদ= إيدহওয়ার কথা, عيد = ‘ঈদ হওয়ার কথা, ইফাবাসহ বাংলাদেশি আরবিবিদগণের প্রণীত প্রতিবর্ণায়ন রীতিতে  দীর্ঘ ঈ দিয়ে মাদ্দ বুঝাচ্ছেন, উল্টা কমা দিয়ে আইন বুঝাচ্ছেন না কেন? ভাবুন তো, সব জায়গায় সহীহ প্রতিবর্ণায়নের দোহাই দিয়ে ঈদের আগে বাধ্যতামূলক উল্টা কমা লাগিয়ে দেওয়া হলো, কেমন লাগবে দেখতে? কিংবা নবীর স্থানে যদি নাবিয়্য্ লেখা হয়? তাহলে?? কিংবা কেউ যদি বলেন আজ থেকে আমরা আর কলম দিয়ে লিখবো না, লিখবো “ক্বালাম” দিয়ে, তাহলে  কেমন লাগবে?! (কিন্তু সূরাহ আল-ক্বালাম লেখা যেতে পারে, কারণ এখানে আল-ক্বালাম মূল আরবি হিসেবেই এসেছে, বাংলা কলম নয়। শাব্দিক অর্থ এক হলেও দুই ভাষার শব্দের উচ্চারণ ও বানানে বেশ-কম থাকাটাই যৌক্তিক।)
কাজেই আত্তীকৃত শব্দের প্রতিবর্ণায়নে বাংলা রীতির প্রাধান্য মেনে নিন, আরবি প্রতিবর্ণায়নের চিন্তা বাদ দিন, এটাই যৌক্তিক। আত্তীকৃত নয়, এমন শব্দে ক্ষেত্রে প্রতিবর্ণায়ন কীভাবে হবে, সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আত্তীকৃত শব্দ কখনোই পুরোপুরি মূল শব্দের মতো উচ্চারিত হয় না, বরং যে ভাষায় আত্তীকৃত হয়েছে, সে ভাষার ধ্বনিশৃঙ্খলা অনুযায়ীই উচ্চারিত হয়। আমাদের আলোচ্য ঈদ শব্দটি উচ্চারণের ক্ষেত্রে কেউই  ع বর্ণের ধ্বনির প্রতি লক্ষ্য রাখেন না, বাংলা ভাষায় যেসকল ধ্বনি আছে, সেগুলো দিয়েই উচ্চারণ করেন। উচ্চারণে যদি মূল ধ্বনির প্রতি লক্ষ্য না রাখা হয়, তাহলে বানানে লক্ষ্য রাখা কতটা জরুরি? আর রাখতে গেলে যেসব পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, সেটা তো উপরেই আলোচনা করেছি।
ফেসবুকে একটা হাস্যকর অভিযোগ দেখতে পেলাম, ইদ লিখলে নাকি সেটা আরবি ইদ্দতের মতো হয়ে যায়, এটা সম্ভবত আরবি না জানা কিংবা টুকটাক শুনে শুনে জানার কারণেই সামনে এসেছে। যদি ধরেও নিই, ইদ লেখার কারণে মূল আরবি শব্দ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তাহলে ইদ=إدহবে আর ঈদ=إيد হবে, কোনটা দ্বারাই আমাদের উদ্দিষ্ট ঈদও হবে না, আবার ইদ্দতও হবে না, এটাই বাস্তবতা!
তাই, আরবি ভাষা নিয়ে টানা-হেচড়া না করে, ঐতিহ্য, প্রথা ও প্রচলনের দিকে তাকিয়ে ঈদ লিখুন, আমার কোন আপত্তি নেই। আরবি ভাষার কথা বলতে চাইলে এরকম অসংখ্য আপত্তি উপস্থাপন করতে পারবো– আরবি ভাষার ছাত্র হিসেবে, এবং আরবি ও বাংলা ধ্বনি সম্পর্কে মোটামোটি প্রাথমিক ধারণা রাখি বলে। সেক্ষেত্রে এসব আপত্তির জবাব কিন্তু দিতে হবে!
(২০১৮ সালের ১৭ জুন ফেসবুকে প্রথম প্রকাশিত। ব্লগে ইষৎ সম্পাদিত আকারে প্রকাশিত।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *