সিলেটি নাগরি বর্ণমালা বনাম বাংলা বর্ণমালা:আংশিক পর্যালোচনা

বাংলায় প্রায় ৫০ টি বর্ণ আছে। তন্মধ্যে কিছু বর্ণ একেবারে অপ্রয়োজনীয়, সংস্কৃতের অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে বর্ণমালা থেকে সে গুলোকে বিদায় করা যাচ্ছে না। সিলেটি নাগরি এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র। কারো অন্ধ অনুকরণে বর্ণমালায় কোন বর্ণকে স্থান দেয়া হয় নি। বরং শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় বর্ণ গুলোই নাগরিতে আছে। 
.
উদাহরণস্বরূপ, বাংলা স্বরবর্ণ ১১ টি, কিন্তু নাগরি স্বরবর্ণ মাত্র ৫ টি। চলুন দেখা যাক, কেন এই বেশ কম? 
.
সিলেটি নাগরি লিপির ৫ টি স্বরবর্ণ হলোঃ আ, ই, উ, এ, অ(/ও)। (প্রত্যেকটির নাগরি রূপ আছে, তবু সবার সুবিধার্থে বাংলায় দিলাম।) 
.
তা হলে দেখা যাচ্ছে, বাংলা ঈ, ঊ, ঋ, ঐ, ও(/অ), ঔ এই ৬ টি স্বরবর্ণ সিলেটি নাগরিতে নেই। কেন? 
.
ঈ এবং ঊ যে শুধু সিলেটিতে নয়, বাংলা ভাষায়ও অপ্রয়োজনীয়, তা বাংলা একাডেমির বানান রীতি পড়লেই বোঝা যায়। এমনকি বাংলা একাডেমির শেষের ঈ কারটাও আজকাল আর দেখা যায় না। সেটাকে আইন করে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। বাংলা ভাষাবিদরা আজ যা ভাবছেন ঈ ও ঊর ব্যাপারে, সিলেটি নাগরির উদ্ভাবকরা শত শত বছর আগেই তা বাস্তবায়িত করেছেন! 
.
ঐ এবং ঔ মূলত আলাদা কোন স্বরবর্ণ নয়, বরং ও+ ই= ঐ এবং ও+ উ= ঔ। তাই আলাদাভাবে এ দুটি বর্ণ রাখার দরকার কি? সিলেটি নাগরি লিপির উদ্ভাবকরা তাই অপ্রয়োজনীয় এই দুটি বর্ণ রাখেন নি। 
.
ঋ। এই বর্ণটিকে স্বরবর্ণের তালিকায় রেখে স্বরবর্ণের সংজ্ঞাকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। সংস্কৃতে নাকি এটি স্বরবর্ণ, হতে পারে, তাই বাংলাতেও স্বরবর্ণের তালিকায় এটি আছে, অথচ বাংলায় কিংবা সিলেটিতে এটি মোটেও স্বরবর্ণ হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। তাই নাগরি লিপিতে এটি নেই। 
.
অ এবং ও। বাংলায় দুটি পৃথক বর্ণ, এদের উচ্চারণও আলাদা। কিন্তু সিলেটিরা এ দুটি বর্ণকে একইভাবে উচ্চারণ করেন, কোন ধরণের পার্থক্য ছাড়াই। (ক্ষেত্রবিশেষ ও বর্ণটি উ কিংবা অউএর মতো উচ্চারিত হয়।) সিলেটি নাগরি যেহেতু সিলেটিদের বর্ণমালা, তাই নাগরিতে এ দুটি বর্ণের বদলে আছে মাত্র একটি বর্ণ। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে বাংলা কিংবা সংস্কৃতের অন্ধ অনুকরণ করা হয় নি বরং সিলেটি উচ্চারণের প্রতি খেয়াল করা হয়েছে। 
.
উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান, সিলেটি নাগরি বর্ণমালা কারো অন্ধ অনুকরণে নয় বরং সিলেটিদের মুখের ভাষাকে কেন্দ্র করে উদ্ভাবিত হয়েছে। আর স্বকীয়তা ও আধুনিকতার দিক থেকে এ বর্ণমালা বাংলা বর্ণমালার চেয়েও এগিয়ে! 
.
.
(লেখার কলেবর বৃদ্ধির ভয়ে স্বরবর্ণের আলোচনা করেই শেষ করলাম, ব্যঞ্জনবর্ণ সম্পর্কেও একই রকম আলোচনা করা যেতে পারে।)
.
বি.দ্র: প্রায় বছর দুয়েক আগে সিলেটিদের একটি ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করেছিলাম এ লেখাটি। কীভাবে যেন আমার মোবাইলের নোট অপশনে এটি সংরক্ষিত থেকে যায়। খুব বেশি সংশোধন না করেই এটি আবার পোস্ট করলাম। 
.
.
সংযোজনী: সিলেটি নাগরি হরফ কম্পিউটারে লেখার জন্য কয়েকটি ফন্ট উদ্ভাবিত হয়েছে। তন্মধ্যে ব্রিটেনভিত্তিক STAR (Sylheti Translation and Research centre) উদ্ভাবিত নিউ সুরমা বাংলা সুতন্বী এমজের সাথে তুলনীয়। স্টার বিজয়ের মতো আলাদা কীবোর্ডও তৈরি করেছিল, তবে লেটেস্ট ভার্সনের উইন্ডোজে সেটা পুরোপুরি কাজ করে না। শুনেছি, ইদানীং নিউ সুরমা ফন্ট নাকি অনলাইনে পাওয়া যায় না। (আমার সংগ্রহে ফন্টটি আছে) 
পরবর্তীতে নিউ সুরমাকে ভিত্তি ধরে একটি ইউনিকোড ফন্ট তৈরি করা হয়। আমার জানা মতে ইউনিকোডে লেখার জন্য সিলেটি নাগরির আলাদা কোন সফটওয়্যার নেই। আমি ইউনিকোড বাংলা লেখার জনপ্রিয় সফটওয়্যার অভ্রতে ব্যবহার উপযোগি একটি কীবোর্ড লেআউট তৈরি করেছিলাম, সেটিতে কয়েকটি কার চিহ্ন লিখতে কিছুটা সমস্যা হয়। গত দুই বছর এসব প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, এখন আবার চেষ্টা করে দেখব কার চিহ্নের সমস্যাটা ফিক্স করা যায় কি না। ইউনিকোডে লেখার জন্য এর চেয়ে ভালো কোন উপায় কারো জানা থাকলে শেয়ার করলে খুশি হব।
কিছুদিন পূর্বে নাগরি নিয়ে কাজ করে এমন একটি ফেসবুক গ্রুপ নিউ সুরমা ফন্ট না পেয়ে নিজেরাই একটি ফন্ট তৈরি করে। নিউ সুরমা বা ইউনিকোডের তুলনায় ফন্টটি খুব মানসম্মত নয়। অবশ্য তারা এই ফন্টের সাহায্যে প্রথম সিলেটি নাগরি লিপির পত্রিকাও প্রকাশ করে। এদিক থেকে তাদের এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। 
.
[পুনশ্চ: গত কয়েক দিন আগেই সিলেটি উচ্চারণবিষয়ক একটি পোস্টে এই লেখার ঘোষণা দিয়েছিলাম। সেখানে এই লেখা সংক্ষিপ্ত হবে বলে আশা প্রকাশ করে ছিলাম, আসলেও লেখাটি বেশ সংক্ষিপ্ত ছিল, কিন্তু কম্পিউটার ফন্ট সম্পর্কে তথ্য সংযোজন করতে গিয়ে সে কথা রাখতে পারি নি।]

One thought on “সিলেটি নাগরি বর্ণমালা বনাম বাংলা বর্ণমালা:আংশিক পর্যালোচনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *