প্রাচীনকালে বড় দুটি সেনাবাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে উভয়পক্ষের নামকরা বীরদের মধ্যে মল্লযুদ্ধ হতো। মল্লযুদ্ধে দু’জন বীরযোদ্ধার মধ্যে যে কোনো একজনের মৃত্যু নিশ্চিত ছিল।
এ ধরনের যুদ্ধের যুগ শেষ হয়েছে বহু আগেই, এখন কেবল ইতিহাসের পাতাতেই এসব পাওয়া যায়। তবে চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের অংশ হিসেবে হুয়াওয়ের সঙ্গে গুগলের চুক্তি বাতিল প্রাচীনকালের মল্লযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। প্রযুক্তিদৈত্য হুয়াওয়ের মূল কাজকারবার নেটওয়ার্কিং নিয়ে, ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক স্থাপনের দৌড়ে তারাই সবচেয়ে এগিয়ে আছে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। তবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের কাছে হুয়াওয়ের পরিচয় বৃহৎ মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী কোম্পানি হিসেবে। এতদিন এই চীনা কোম্পানিটি তাদের মোবাইল ফোনে মার্কিন কোম্পানি গুগলের অপারেটিং সিস্টেম অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহার করত। কিন্তু এখন থেকে তারা আর অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহার করতে পারবে না।
চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের বিশাল আকারের তুলনায় গুগল বনাম হুয়াওয়ে সংঘাত বলতে গেলে মল্লযুদ্ধই বটে, মূল যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধে প্রথম আঘাত হেনেছে মার্কিন যোদ্ধা গুগল, হুয়াওয়েকে নিষিদ্ধ করে। হুয়াওয়ে পাল্টা রক্ষণাত্মক পদক্ষেপ হিসেবে নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। এখন দেখার বিষয় হুয়াওয়ের পাল্টা আঘাত গুগলের গায়ে লাগে কিনা।
বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম হল অ্যান্ড্রয়েড। সব ধরনের ব্যবহারকারীর কাছে অ্যান্ড্রয়েডের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। এরকম গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করা হুয়াওয়ের পক্ষে কঠিনই হবে। কারণ ব্যবহারকারীরা এতদিন স্যামসাং, হুয়াওয়ে কিংবা অন্য যে কোনো ব্র্যান্ডের (অ্যাপল ছাড়া) স্মার্টফোন ব্যবহার করলেই অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ ব্যবহার করতে পারত। হুয়াওয়ে যদি ভিন্ন প্লাটফর্মে চলে যায়, তাহলে তাদের ব্যবহারকারীদের জন্য আলাদা অ্যাপ দরকার হবে। নতুন প্লাটফর্মটির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে পর্যাপ্ত অ্যাপ বাজারে নিয়ে আসা। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ ফ্রিল্যান্সার নিজেদের উদ্যোগে অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ বানাচ্ছেন, প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজেদের অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ বানাচ্ছে। এরকম হাজার হাজার জনপ্রিয় অ্যাপ রয়েছে, যেগুলোর নিজস্ব সংস্করণও বাজারে আনতে হবে হুয়াওয়েকে। ফ্রিল্যান্স ডেভেলপাররা ও প্রতিষ্ঠানগুলো যদি স্বেচ্ছায় এ কাজটি না করে, তাহলে হুয়াওয়ের আসলে তেমন কিছুই করার থাকবে না, আবার এগুলো ছাড়া জনপ্রিয়তা অর্জনও অসম্ভব হয়ে পড়বে। অবশ্য ডেভেলপারদের আগ্রহী করে তুলতে কোম্পানির পক্ষ থেকে উদ্যোগের কমতি থাকবে না নিশ্চয়ই।
হুয়াওয়ে যদি এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম না হয়, তবে স্মার্টফোনের বাজার থেকে তাকে চিরতরে বিদায় নিতে হবে। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে নোকিয়া বাজার থেকে হারিয়ে গিয়েছিল অ্যান্ড্রয়েডের দাপটের কারণে। অথচ নোকিয়ার ওপর গুগলের কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। তারপরও নোকিয়া অ্যান্ড্রয়েডের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তাদের নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম সিম্বিয়ানকে জনপ্রিয় করতে পারেনি, একসময়ের প্রবল প্রতাপশালী মোবাইল কোম্পানিটি অ্যান্ড্রয়েডের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। সেখানে গুগলের নিষেধাজ্ঞার মুখে হুয়াওয়ে কীভাবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে, তা এখন দেখার বিষয়।
হুয়াওয়ে এ পর্যায়ে ব্যর্থ হলে মল্লযুদ্ধে গুগলের বিজয় নিশ্চিত হবে, যা বাণিজ্যযুদ্ধে আমেরিকাকে অনেকটাই এগিয়ে দেবে। তবে চীনা মল্লযোদ্ধা হুয়াওয়ে নিশ্চয়ই এত সহজে হাল ছাড়বে না। যদি তারা কোনোভাবে অ্যান্ড্রয়েডকে বাদ দিয়ে মোবাইল ফোনের বাজারে নিজেদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সক্ষম হয়, তবে অ্যান্ড্রয়েড বড় হুমকির মুখে পড়বে। নতুন অপারেটিং সিস্টেম গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হলে অন্যান্য চীনা কোম্পানিও অ্যান্ড্রয়েড ছেড়ে দেশীয় অপারেটিং সিস্টেমে চলে আসবে। চীনের বাইরেও অ্যান্ড্রয়েডের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ দাঁড়িয়ে যাবে, যা কোনোভাবেই গুগলের কাম্য নয়। সেক্ষেত্রে চীনই হবে বাণিজ্যযুদ্ধে এই মল্লযুদ্ধের প্রকৃত বিজয়ী।