সুলতানী বাংলার মাদরাসা শিক্ষা ও বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা

sultanate education

বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) মধ্য যুগে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত এ অঞ্চলে কোন একক রাষ্ট্র কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহই বাংলার ইতিহাসের প্রথম শাসক, যিনি নানা জনপদে বিভক্ত বাংলা অঞ্চলটিকে একটি একক শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তিনি শাহ-ই-বাঙ্গালা নামে এবং তার প্রতিষ্ঠিত সে রাষ্ট্রটি বাঙ্গালা নামে পরিচিতি লাভ করে। ইলিয়াস শাহের শাসনামল ছিল ১৩৩৯ থেকে ১৩৫৮ সাল অবধি। সে হিসেবে বলা যায়, বাংলায় মুসলমানদের প্রথম প্রবেশের (১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দীন বখতিয়ার খলজি কর্তৃক) প্রায় দেড় শত বছর পর বাংলার বেশির ভাগ অঞ্চল জুড়ে স্বাধীন মুসলিম সালতানাত তথা প্রথম বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৫৭৬ সালে সালতানাতের পতন ঘটে এবং বাংলা মুগলদের অধীনে চলে যায়। বর্তমান প্রবন্ধে প্রধানত সুলতানী শাসনামলের মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে মসজিদই ছিল জ্ঞানের চর্চাকেন্দ্র। আরব উপদ্বীপের বাইরে বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার প্রসার হওয়ার পরও মুসলিম বিশ্বে জ্ঞানের প্রধান চর্চাকেন্দ্র হিসেবে মসজিদের গুরুত্ব বহাল ছিল। পরবর্তীতে রাজধানীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে মসজিদ ছাড়াও স্বতন্ত্র মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। শাসকদের পাশাপাশি দানশীল উচ্চবিত্ত ব্যক্তির্গের পৃষ্ঠপোষকতায়ও অনেক মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। আব্বাসী আমলে আরব বিশ্বের বাইরে নতুন বিজিত মুসলিম শাসনাধীন বিভিন্ন এলাকায়ও এরকম উচ্চমানের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র গড়ে উঠতে শুরু করে।

বাংলাও এই প্রবণতার বাইরে ছিল না। বাংলাজয়ী প্রথম মুসলিম শাসক ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজী ও অন্যান্য খলজী শাসকগণের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোগে তাদের রাজধানী শহর ও অন্যান্য কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে বহু মসজিদ, মাদরাসা ও খানকা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়। পরবর্তীতে বিভিন্ন মুসলিম শাসকদের শাসনামলে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আরো অনেক শহর গড়ে উঠে, সেসব শহরেও বহু মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।

সুলতানী আমলের কতিপয় বিখ্যাত মাদরাসা

প্রাচীন শিলালিপিসমূহ ও ঐতিহাসিক বিভিন্ন বর্ণনা থেকে সুলতানী আমলের অনেক প্রসিদ্ধ মাদরাসার বর্ণনা পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার নাম উল্লেখযোগ্য। সুলতান রুকনুদ্দীন কায়কাউস (শাসনকাল ১২৯১-১৩০১) এর আমলে এই এলাকার কাজী নাসিরের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়। একই এলাকায় পরবর্তীতে সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের আমলে (১৩০১-১৩২২) ‘দারুল খায়রাত’ নামের আরেকটি মাদরাসার বিবরণ পাওয়া যায়। কোন কোন ঐতিহাসিক অবশ্য এ দুটি মাদরাসাকে একই মাদরাসা বলে গণ্য করেছেন। তবে শিলালিপিসমূহের ভাষ্য অনুসারে দুটি ভিন্ন মাদরাসার অস্তিত্ব প্রতীয়মান হয়।

নবগ্রাম শিলালিপি থেকে সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের আমলে (১৪৪২-১৪৫৯) খিত্তা শিমলাবাদ অঞ্চলে একটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এ শিলালিপির বর্ণনা অনুসারে ঐতিহাসিকগণের ধারণা, খিত্তা শিমলাবাদ বর্তমান পাবনার উত্তরাঞ্চল, বগুড়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং রাজশাহীর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। এ লিপিতে মাদরাসার আলাদা বর্ণনা না থাকলেও উলামা ও মুতাআল্লিমুন (শিক্ষার্থী) প্রভৃতি পরিভাষার উল্লেখ থেকে বিশেষজ্ঞগণ এ অঞ্চলে মাদরাসার অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন।

১৫০২ সালের আরেকটি শিলালিপি থেকে সুলতান আলাউদ্দীন হুসাইন শাহের আমলে (১৪৯৩-১৫১৯) প্রতিষ্ঠিত একটি মাদরাসা সম্পর্কে জানা যায়। শিলালিপিতে মাদরাসার অস্তিত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও মাদরাসার অবস্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নাই। ফলে এ মাদরাসার অবস্থান নিয়ে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। তবে অনেকের ধারণা এ মাদরাসাটি খুব সম্ভব গৌড়ের ছোট সাগর দিঘী অঞ্চলের বেলবাড়ি (গঙ্গা ও মহানন্দা নদীর মধ্যখানে অবস্থিত ভূখণ্ড, বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ শহরের দক্ষিণে অবস্থিত: বাংলাপিডিয়া) এলাকায় অবস্থিত ছিল।  ১৫১০ সালের দিকে একই সুলতানের আমলের আরেকটি মসজিদ সম্পর্কে জানা যায়, যে মসজিদে পুরোপুরি পাঠকার্যক্রম চলতো বলে ঐতিহাসিকগণ ধারণা করেন।

হুসাইন শাহী বংশের শাসনকালে প্রতিষ্ঠিত বাঘা (রাজশাহী শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ২৫ মাইল দূরে) অঞ্চলে একটি জামে মসজিদ ও মাদরাসার সন্ধান পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক বর্ণনায় অনুসারে এ অঞ্চলে জনৈক হাওদা মিয়া একটি উচ্চতর মাদরাসা পরিচালনা করতেন। গবেষকদের মতে, হাওদা মিয়া খুব সম্ভবত হযরত হামিদ দানিশমান্দ রহ.’র নামের অপভ্রংশ হতে পারে।

বিভিন্ন শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে সুলতানী আমলের কয়েকটি মাদরাসা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো। এছাড়াও প্রাচীন বিভিন্ন রচনাবলি থেকেও অনেক মাদরাসার বিবরণ পাওয়া যায়। যেমন মহিসুন তথা বর্তমান রাজশাহীর মহিসন্তোষে ঈসায়ী ত্রয়োদশ শতকের মধ্যভাগে মাওলানা তকিউদ্দীন আরাবী রহ.-র প্রতিষ্ঠিত একটি মাদরাসা সম্পর্কে প্রাচীন গ্রন্থাদি থেকে জানা যায়। হযরত আরাবী প্রতিষ্ঠিত এ মাদরাসাকে কেন্দ্র করে মহীসন্তোষের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয় এবং সালতানাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়। পরবর্তীতে সুলতান রুকনুদ্দীন বারবাক শাহ (১৪৫৯-১৪৭৪) এ শহরে টাকশাল স্থাপন করেন। তখন তারই নামে শহরটির নাম হয় বারবাকাবাদ। মাদরাসার নাম-যশ ও বাংলার সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে সে যুগে উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা এ মাদরাসায় অধ্যয়নের জন্য আসতেন।

সুলতানী আমলের মাদরাসাসমূহের আলোচনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের দাবিদার আল্লামা শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা রহ. এর মাদরাসাটি। তিনি ১২৮১ সালে ঢাকার সোনারগাওয়ে এসে বসতি স্থাপন করেন, এবং খানকা ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ঐতিহাসিকদের প্রাপ্ত তথ্য মতে, বাংলায় আবু তাওয়ামা রহ.-র মাদরাসাতেই প্রথম ইলমে হাদীসের নিয়মতান্ত্রিক অধ্যয়ন-অধ্যাপনার সূচনা হয়। এ মাদরাসায়ও উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা অধ্যয়ন করতেন। আল্লামা আবু তাওয়ামার মাদরাসাটিতে ধর্মীয় ও পার্থিব উভয় ধরনের বিষয়াদি অধ্যয়নের ব্যবস্থা ছিল। তিনি ১৩০০ সালের দিকে ইন্তেকাল করলেও তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান দীর্ঘকালব্যাপী বাংলা সালতানাতের শিক্ষা-দীক্ষার উন্নয়নে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিল।

ইলিয়াস শাহি বংশের অনেক সুলতানের রাজধানী ছিল পান্ডুয়া। ফলে এ শহরেও গড়ে উঠেছিল অসংখ্য  মাদরাসা ও খানকা। এ সকল সুলতান তাঁদের রাজধানীতে জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ ও শিক্ষার্থীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করতেন। তাই তাঁদের রাজধানীতে সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও বহু মাদরাসা গড়ে উঠে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সে যুগের প্রথিতযশা সূফী শায়খ হযরত নুর কুতুব আলম রহ.-র প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা ও বিমারিস্তান বা হাসপাতাল। সুলতান আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ এসকল প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রচুর লাখেরাজ ভূমি বন্দোবস্ত করে দেন।

এছাড়া বর্তমান বগুড়ার মহাস্থানগড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে মানকালির ঢিবিতে সুলতানী আমলের একটি জামে মসজিদের ভগ্নাবশেষ পাওয়া যায়। এ মসজিদে তিনটি মঞ্চ সদৃশ স্থাপনা পাওয়া যায়। অধ্যাপক ইয়াকুব আলীর পর্যবেক্ষণ অনুসারে, এ তিনটি মঞ্চ খুব সম্ভবত শিক্ষকগণ ছাত্রদের শিক্ষাদানের কাজে ব্যবহার করতেন। এ মসজিদের স্থাপত্য কাঠামো বিশ্লেষণ করলে খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে, এ কমপ্লেক্সে মসজিদের পাশাপাশি একটি মাদরাসাও ছিল।

এসব তথ্য থেকে গবেষকগণ অনুমান করেন, সে যুগে প্রাশাসনিক সদর শহরসমূহে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরে সুলতান অথবা সুলতানের প্রতিনিধিদের উদ্যোগে মাদরাসা প্রতিষ্ঠিতি হতো, আবার আলিম ও সূফীগণের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায়ও বহু মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হতো। স্বভাবতই সকল মাদরাসার শিলালিপি কিংবা প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শন অথবা অন্য কোন ধরনের বিবরণ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফলে উপরিউক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ ছাড়াও নিঃসন্দেহে আরো বহু মাদরাসা সুলতানী আমলে গড়ে উঠেছিল বলে উপলব্ধি করা যায়। তবে যেটুকু তথ্য এখন অবধি গবেষকগণ পেয়েছেন, তাতে সে যুগে বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি ও সমৃদ্ধি গবেষকদের চোখ এড়ায় না।

সুলতানী আমলের মাদরাসার পাঠ্যক্রম

সে যুগের শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যবিষয় সম্পর্কে সুনিশ্চিত তথ্য উপস্থাপন করা খুবই কঠিন। তবে সুলতানী আমলে এ সকল মাদরাসাই ছিল মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় ও পার্থিব সকল বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা এসকল প্রতিষ্ঠানেই অধ্যয়ন-অধ্যাপনা করতেন, এ বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। ফলে খুব সহজে অনুমান করা যায়, সে যুগের মাদরাসাসমূহে ধর্মীয় বিষয়সমূহের পাশাপাশি মানব জীবনে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পার্থিব জ্ঞানের চর্চাও এসকল মাদরাসাতেই হতো। যাই হোক, বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে সুলতানী আমলের মাদরাসাসমূহের পাঠ্যক্রম সম্পর্কে আংশিক ধারণা লাভ করা সম্ভব।

মুসলিম শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা সুলতানী আমলে মসজিদভিত্তিক মকতব কেন্দ্রিক ছিল। সাধারণত শিশুরা চার-পাঁচ বছর বয়সেই মসজিদভিত্তিক মকতবসমূহে প্রাথমিক ও আবশ্যিক ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে তাদের শিক্ষাজীবন শুরু করতো। ফার্সি ভাষায় রচিত নাম-ই-হক নামের একটি ফিকহের কিতাব প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ানো হতো। প্রাথমিক পর্যায়ে মকতবে আরবী, ফার্সী এবং বাংলা ভাষা পড়ানো হতো। ধর্মীয় কারণে আরবী, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ফার্সী এবং মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা অধ্যয়ন করতে হতো। অবশ্য সবক্ষেত্রে বাংলা যে সমান গুরুত্ব পেতো, তেমনটা নয়। আবার প্রাথমিক পর্যায়ে আরবী ভাষা শিক্ষা বলতে অনেকে ক্ষেত্রে কেবল বিশুদ্ধ উচ্চারণে কুরআন শরীফ তিলাওয়াতের যোগ্যতাকেই গণ্য করা হতো।

মকতব থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের পর যারা শিক্ষাজীবন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেন, কেবল তারাই মাদরাসায় উচ্চশিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে ভর্তি হতেন।  খুব স্বাভাবিকভাবে মাদরাসায় কুরআন শরীফের তাফসীর ও হাদীস শরীফের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্পর্কিত গ্রন্থসমূহ অবশ্যপাঠ্য ছিল। পাশাপাশি ইলমে ফিকহের উচ্চতর পড়াশুনা এসব মাদরাসার অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল। এমনকি বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দীন আজম শাহ পবিত্র মক্কা শরীফে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে জানা যায়, সে মাদরাসায়ও চার মাযহাবের ফিকহের উচ্চতর পাঠদান করা হতো। গিয়াস উদ্দীন আজম শাহ হানাফী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন, সে হিসেবে তার পরবর্তী উত্তরসূরী সুলতানগণও হানাফী হওয়াই যুক্তিসঙ্গত। তবে মক্কা শরীফে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায় সকল মাযহাবের শিক্ষার্থীদেরকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হতো, বাংলার সুলতানগণ হানাফী হলেও তারা এক্ষেত্রে যথেষ্ট উদারতা প্রদশন করতেন। যদিও বাংলার মাদরাসাসমূহে সে যুগ থেকেই হানাফী ফিকহই বিশেষভাবে চর্চা করা হতো, যেহেতু এ অঞ্চলের মুসলমানগণ হানাফী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন।

এসকল বিষয় ছাড়াও সুলতানী আমলের মাদরাসাসমূহে যুক্তিবিদ্যা, পাটীগণিত, চিকিৎসা, রসায়ন, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা, কৃষি, লোকপ্রশাসন, বিজ্ঞান, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ও পড়ানো হতো। এ বিষয়ে পরবর্তী সুলতানী আমলের কোন বিস্তারিত বিবরণ না পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে মোঘল পণ্ডিত আবুল ফজল আল্লামার লেখা আইন-ই-আকবরিতে এসব বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে।

সুলতানী আমলের মাদরাসাসমূহে চিকিৎসা শাস্ত্রের গুরুত্ব কিছুটা উপলব্ধি করা যায় একটি শিলালিপিতে উল্লেখিত সুলতান জালাল উদ্দীন ফতেহ শাহের উপাধি থেকে। সেখানে তাকে কাশিফে আসরারে কুরআন এবং ধর্ম ও শরীর বিদ্যার পণ্ডিত হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এ থেকে উপলব্ধ হয় সেকালে এসব বিষয়ে উচ্চশিক্ষা অত্যন্ত সম্মানজনক বলে বিবেচিত হতো।

এছাড়া গিয়াস উদ্দীন আজম শাহ ছিলেন তাঁর সময়ের বিখ্যাত তীরন্দাজ, ধারণা করা হয় এ বিষয়টিও সে কালের মাদরাসাসমূহের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এমনকি আলাউদ্দীন হুসাইন শাহের আমলে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় সাইয়্যিদ মীর আলভী রচিত হেদায়াতুর রামী বা তীরন্দাজ-নির্দেশিকা  নামে একটি পাঠ্যপুস্তকেরও সন্ধান পাওয়া যায়।

সুলতানী আমলে সুন্দর হস্তাক্ষর শিল্পের মর্যাদা পেতো। এ কারণের মাদরাসা ও মকতবসমূহে সুন্দর হস্তাক্ষরের চর্চাও হতো। তারই ফলস্বরূপ বিভিন্ন শিলালিপিতে চমৎকার আরবী-ফার্সী লিপির সন্ধান মিলে। তাছাড়া প্রিন্টিং প্রেস আবিষ্কারের পূর্বযুগে বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের চাহিদা মেটানোর জন্যও সুন্দর হস্তাক্ষরের প্রয়োজনীয়তা ছিল অনস্বীকার্য। ফলে হস্তাক্ষরে দক্ষতার পেশাগত মূল্যও ছিল সে যুগে।

সুলতানী আমলের বাংলার মাদরাসাসমূহের প্রায় সব পাঠ্যপুস্তকই ছিল আরবী-ফার্সীতে লেখা। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এ দুটি ভাষাই ব্যবহৃত হতো। ফলে উচ্চশিক্ষাঙ্গনে এ দুটি ভাষার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। উচ্চশিক্ষাঙ্গনে ও সরকারি কার্যক্রমে আরবী-ফার্সী ভাষার দক্ষতা আবশ্যিক ছিল। এসব কারণে মাদরাসাসমূহে এ দুটি ভাষা বিশেষ গুরুত্বের সাথে পঠিত হতো।

বর্তমান বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও সুলতানী আমলের শিক্ষাব্যবস্থা

বর্তমানে বাংলাদেশে বহু ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। তন্মধ্যে মাদরাসা শিক্ষাই মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত— আলিয়া ধারা (তথা বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত) ও কাওমী ধারা (হাইআতুল উলয়া ও বহু সংখ্যক বোর্ড নিয়ন্ত্রিত)।

তবে সুলতানী আমলের মূলধারার মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বৈশিষ্ট্যের বিচারে বর্তমানে প্রচলিত আলিয়া ধারার পূর্বসুরী শিক্ষাব্যবস্থাই হচ্ছে সুলতানী আমলের শিক্ষাব্যবস্থা। কারণ সুলতানী আমলের মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যক্রমের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ইসলামী বিষয়সমূহ ও অন্যান্য পার্থিব বিষয়াদি একই প্রতিষ্ঠানে সমন্বিত আকারে পাঠদান করা। এবং সেসব  প্রতিষ্ঠান যে যুগের বিখ্যাত আলিম ও সূফীগণ পরিচালনা করতেন, সালতানাত থেকে তাঁর সব ধরনের সহযোগিতা পেতেন।

বর্তমানে আলিয়া শিক্ষাব্যবস্থায়ও একই ভাবে আলিয়া ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ইসলামী জ্ঞান ও পার্থিব জ্ঞানের সমন্বিত পাঠদান করা হয়। সে যুগের চাহিদা অনুযায়ী যেখানে ফার্সী পড়ানো হতো, এখন হয়তো তার বদলে ইংরেজি পড়ানো হচ্ছে। সে যুগে সরাসরি চিকিৎসা শাস্ত্র মাদরাসায় পড়ানো হতো, এখন সে সুযোগ না থাকলেও চিকিৎসা শাস্ত্রে অধ্যয়নের জন্য আবশ্যিক জীববিজ্ঞান ঠিকই এখনও মাদরাসাসমূহের বিজ্ঞান বিভাগে পড়ানো হচ্ছে। এছাড়া যুগের প্রেক্ষাপট অনুসারে কয়েকটি বিষয়ে ব্যতিক্রম থাকলেও বর্তমান আলিয়া মাদরাসা ধারা ও সুলতানী আমলের মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য খুব একটা নেই। উপরের আলোচনা থেকে তাই প্রতীয়মান হয়। তবে পাঠদানের মান ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব প্রভৃতি ক্ষেত্রে বর্তমান আলিয়া ধারা সে যুগের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে বর্তমানে, যা খুবই দুঃখজনক। তবে সুলতানি আমলের মাদরাসাসমূহ ‍ছিল সে যুগের মূলধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বর্তমানে আলিয়া মাদরাসা থেকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকলেও বাস্তবে মূলধারার মর্যাদা এখন আর মাদরাসার জন্যে বরাদ্দ নেই। বরং সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা (যেখানে ধর্মীয় শিক্ষা নেই বললেই চলে) এখন বাংলাদেশের মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থার স্বীকৃতি পাচ্ছে। সুতরাং বলা যেতে পারে, আলিয়া, কৌমি এবং সাধারণ— এই তিন ব্যবস্থার সম্মিলিত যে রূপটির কথা কল্পনা করা যেতে পারে, সেটিই ছিল সে যুগের মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। বর্তমানে এককভাবে কোন একটি ব্যবস্থাই সুলতানি শিক্ষা ব্যবস্থার শতভাগ উত্তরাধিকার দাবি করা তাই অসম্ভবই বটে, যদিও আলিয়া ধারার ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে বর্তমান যুগে সুলতানি শিক্ষা ব্যবস্থার অনুরূপ একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারে বলে প্রতীয়মান।

তথ্যসূত্র:

  •       Education for Muslims under the Bengal Sultanate, Dr. AKM Yaqub Ali.
  •       বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ডক্টর এম.এ রহিম, বাংলা একাডেমি।
  •       মুসলিম বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য, আবদুল করিম, কাকলী প্রকাশনী।
  •     বাংলাপিডিয়া, এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ।

(জকিগঞ্জ ফাজিল সিনিয়র মাদরাসা থেকে প্রকাশিত একটি স্মারকে প্রকাশিত, ঈষৎ সম্পাদিত।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *