ওমর – ভিন্ন স্বাদের উপন্যাস…

এবারের বইমেলায় ফিকশনধর্মী বই একটাই কিনেছি, সেটা ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত রাফিক হারিরির ওমরউপন্যাস। যেদিন কিনেছি, সে রাতেই এক বসায় পুরোটা পড়াও হয়ে গেছে। বই পড়ার পর বুক রিভিউ বা গ্রন্থ সমালোচনা আমি কখনোই লিখি না, এই প্রথম ওমর উপন্যাস পড়ে কিছু লিখতে ইচ্ছে হলো।
28870971 2036470493292465 6626766592174718976 n
ওমরর লেখক আরবি সাহিত্যের ছাত্র, বিশ্ববিখ্যাত অনেক আরবি উপন্যাস অনুবাদ করে এরই মাঝে নাম কামিয়েছেন বেশ। ওমরতার মৌলিক সাহিত্য কর্ম হলেও পাতায় পাতায় প্রাচীন আরবি কবিতার উদ্ধৃতি লেখকের অ্যাকাডেমিক পরিচয়কেই মনে করিয়ে দেয়, যদিও উদ্ধৃতিগুলো খাপছাড়া নয় মোটেই। এসকল উদ্ধৃতি বাঙালি পাঠকের মনে সে সময়ের আরবি সাহিত্য-সংস্কৃতির ছবি কিছুটা হলেও আঁকতে পারবে বলে মনে হয়– আরবি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে এটাই হয়তো লেখক চেয়েছিলেন।
উপন্যাসের অন্যতম পার্শ্বচরিত্র আবুল হারেছ ওরফে ইমরুল হারেছের মুখেই কবিতাগুলো শোনা যায়, ইনি কবি হলেও নিজের কবিতার চেয়ে অন্যদের কবিতাই বেশি আওড়ান, এ জন্যে তাকে আরেক প্রবীণ কবি হুতাইয়ার কাছ থেকে ভণ্ড কবি উপাধিও পেতে হয়েছে অবশ্য।
প্রেম ছাড়া উপন্যাস ঠিক জমে না, অথচ মূল নায়ক (ওমর রা.)কে দিয়ে প্রেম করানোও সম্ভব না, এজন্যই বোধ হয় লেখক এই দায়িত্ব চাপিয়েছেন উল্লিখিত ইমরুল হারেছ আর সুন্দরী উনায়যার কাঁধে। শেষ মুহূর্তে প্রেমের পরিণতিতে মূল নায়কের সহযোগিতার মাধ্যমে উপন্যাসের সাথে এই প্রেম কাহিনীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এর বাইরে উল্লেখ করার মতো আর আছেন প্রাচীন আরবি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান মহিলা কবি খানসা আর তার মেয়ে আনসা। এই মা-মেয়ের সাথে ওমর উপন্যাসের কী সম্পর্ক সেটা পুরোপুরে স্পষ্ট নয়, হয় তো পরবর্তী খণ্ডে স্পষ্ট হবে। ও হ্যাঁ, বইয়ের প্রচ্ছদে কিছু লেখা না থাকলেও শেষ পাতায় ইশারা দেওয়া হয়েছে যে গল্প এখনো শেষ হয় নি, পরবর্তী খণ্ড আসতেও পারে।
এছাড়াও গল্পের প্রয়োজনে আরো অনেক পার্শ্ব চরিত্রের দেখা মিলে, সে সব চরিত্র সম্পর্কে আলাদা আলোচনার দরকার মনে করছি না।
আশপাশের কথা হলো, এবার মূল ঘটনায় প্রবেশ করা যাক। মূলত ওমর রা.র জীবনের নানা ঘটনাই গল্পের আকারে বিভিন্ন অধ্যায়ে তুলে ধরা হয়েছে। আবু বকর রা.র খেলাফতের শেষভাগ থেকেই গল্পের সূচনা, ওমরের খলিফা নির্বাচিত হওয়ার প্রেক্ষাপট উপস্থাপনই সে আলোচনার উদ্দেশ্য বলে মনে হয়েছে। এর আগের ওমরের জীবন কাহিনী এই উপন্যাসে স্বভাবতই স্থান পায় নি, স্থান পেয়েছে শুধুই খলিফা ওমরের কাহিনী তবে তাঁর খেলাফতের শেষ অবধি এই বইয়ে পৌঁছা সম্ভব হয় নি, সম্ভতবত পরবর্তী অংশে সেটা হবে। পাশাপাশি সমসাময়িক রোমান সম্রাট ও তার সেনাপতি, গুপ্তঘাতক, সেনাবাহিনী প্রভৃতি চরিত্রও প্রাসঙ্গিকভাবেই উপন্যাসে প্রবেশাধিকার লাভ করেছে।
সাহিত্য সমালোচকের চোখে বইটি সফল উপন্যাস কি না, সে প্রশ্ন থাকতে পারে, কেননা পুরো উপন্যাস জুড়ে কোন কেন্দ্রীয় গল্প নেই, ওমরের জীবনের নানা বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়েই সাজানো হয়েছে পুরো উপন্যাস। তবে খলিফা ওমরের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা যেভাবে লেখক তুলে ধরেছেন গল্পে গল্পে, তা এক কথায় অনবদ্য।
উপন্যাসটি খলিফা ওমরের জীবনের নানা ঘটনার পাশাপাশি তৎকালীন আরবের জীবনশৈলী, সমাজ, সংস্কৃতি ও মননশীলতাও পাঠকের সামনে মোটামোটি ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
উপন্যাস মূলত ফিকশন হলেও ওমরউপন্যাসটিকে সেই অর্থে পুরোপুরি ফিকশন বলার সুযোগ নেই, কেননা এ উপন্যাসের বেশির ভাগ ঘটনাই ঐতিহাসিক সত্য, এবং ইসলামের ইতিহাসের পাঠক মাত্রই সেগুলো বিভিন্ন ইতিহাসের বইয়ে পড়ে থাকারই কথা।
গল্পের ফাঁকে ফাঁকে কুরআনের উদ্ধৃতি আর ইসলামের ইতিহাসের নানা ঘটনার বর্ণনা, সর্বোপরি ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খলিফার জীবনকে কেন্দ্র করে লেখার ফলে ওমরহয় তো ইসলামি উপন্যাসের তালিকায় ঢুকে পড়েছে, তবে তাতে সাহিত্যের স্বাদ বিন্দুমাত্র কমে নি, ইতিহাসের প্রতি শতভাগ সৎ থাকা সত্ত্বেও, এটা নিঃসন্দেহে লেখকের কৃতিত্ব।
এক বসায় পড়ে ফেলার মতো ঝরঝরে গদ্যে লেখা এ উপন্যাসের বানান ও ভাষারীতি খুব সতর্কতার সাথে নিরীক্ষণ করা হয়নি বলেই মনে হয়েছে, তবে এতে মূল কাহিনীর সাহিত্যমানের খুব একটা ন্যূন হয়নি। সমকালীন বাংলা সাহেত্যে এ ধারার উপন্যাস খুব একটা নেই বললেই চলে, হুমায়ুন আহমদের বাদশাহ নামদারছাড়া উল্লেখযোগ্য উপন্যাস বোধ হয় এটিই। সে হিসেবে লেখক যদি এ ধারার উপন্যাসে থিতু হন, তাহলে আরো উন্নতমানের ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবে, এমনটি আশা করা যায়। শেষ পৃষ্ঠার একদম শেষ লাইনে প্রথম অংশ সমাপ্তকথাটি সে আশা করার সাহস জোগায়, মনে হয় আরো এক বা একাধিক অংশ হয়তো ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্যে সংযুক্ত হবে।
২।
এবার কিছু ছোটখাট বিষয় নিয়ে কথা বলা যাক, যেগুলো বই সম্পর্কে মূল আলোচনায় স্থান পাওয়ার কথা না। বইয়ের কয়েক জায়গায় বানানের ভুল চোখে লেগেছে, প্রুফ রিডার আরেকটু সচেতন হলে হয়তো সেটা এড়ানো যেত।
সাধারণত বাংলা একাডেমির নিয়ম মেনে আরবি শব্দের প্রতিবর্ণায়নে ঈ/ঊ কার এড়িয়ে গেলেও রাসূলশব্দে ঊ কারই আছে, আবার নবিতে ঠিকই ই কারদেওয়া হয়েছে, সুনির্দিষ্ট বানান রীতি অনুসরণ না করার ফলেই এমনটা হয়েছে। 
এছাড়া আলি রা.র উপনাম আবুল হাসানযখন সম্বোধিত পদ হয়েছে, তখন প্রায়ই আবাল হাসানলেখা হয়েছে, আবার কখনো সম্বোধিত পদেও আবুল হাসান লেখা হয়েছে। আরবি বাক্যগঠন রীতির নিয়ম বাংলায় প্রয়োগ না করলেও চলত, বাংলায় আবাল হাসানর তুলনায় আবুল হাসানশ্রুতি মাধুর্যে এগিয়ে বলে মনে হয়। আরেকটি কথা একই চরিত্রের নাম কোথাও আবুল হাসান‘, আবার কোথাও আলিউল্লেখ করা হয়েছে। মূলত আলি রা.র উপনাম আবুল হাসান হলেও অনেক পাঠকের এ তথ্য জানা না থাকার ফলে আলিআর আবুল হাসানকে ভিন্ন দুই চরিত্র মনে করার সুযোগ থেকে যায়। শেষের দিকে এক স্থানে অবশ্য এক সাথে আবুল হাসান আলিএভাবে নাম লেখা হয়েছে, এতে কারো কারো বিভ্রান্তি নিরসন হতেও পারে। তবে কয়েকটি ফুটনোট যেহেতু আছে, কাজেই এই বিষয়টিও ফুটনোটে স্পষ্ট করা যেত।
২৬৮ পৃষ্ঠায় একবার খানসার বদলে আনসার নাম এসেছে ভুলে, পরবর্তীতে সেটা সংশোধিত হবে আশা করি।
মহাবীর খালিদের নাম কোন স্থানে খালিদ‘, আবার কোনস্থানে খালেদলেখা হয়েছে, প্রুফ রিডারের উচিত ছিল যে কোন এক বানান নির্ধারণ করা। অনুরূপ ইমরুল কায়েসআর ইমরাউল কায়েসদুই বানানে একই চরিত্রের নাম এসেছে, অভিন্ন বানান হলে ভালো হতো। সাখার‘, ‘ছাখারআর ছখরর ক্ষেত্রেও একই কথা। একাডেমির বানান রীতিতে সাখারই হওয়ার কথা, তবে নামবাচক বিশেষ্য ছাখারলিখলেও খুব অন্যায় নয়, কিন্তু ভিন্ন বানান লেখাটা খুব ভালো দেখায় নি।
হারেছ‘, ‘ছারির‘ ‘ছালেহ‘, ‘আল আছিমপ্রভৃতি নামে বর্ণের ব্যবহার করাটা মহা অন্যায় কিছু না, তবে আধুনিক রীতিতে লিখলে আরো সুন্দর হতো।
২০৯ পৃষ্ঠায় এক স্থানে গাজাল হরিণীর উল্লেখ আছে। মূলত হরিণের আরবি প্রতিশব্দ গাজাল, কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে গাজাল বোধ হয় বাংলায় হরিণের কোন প্রজাতির নাম-ধাম হবে।
পুরো বইয়ের এরকম টুকিটাকি আলোচনা করতে গেলে বিশাল প্রবন্ধ ফাঁদতে হবে, কিন্তু সেটা তো সম্ভব না। এখানে মূলত বইটি পড়ার পর যে অসঙ্গতিগুলোর কথা বারবার মনে পড়ছিল, শুধু সেগুলোরই উল্লেখ করা হলো, খুঁজে খুঁজে অসঙ্গতি বের করে আলোচনা না করে।
সর্বোপরি, এরকম একটি বইয়ে যে মানের প্রুফ রিডিং দরকার ছিল, সে মানের প্রুফ রিডিং ছাড়াই বইটি প্রকাশিত হয়েছে বলে মনে হয়েছে। পরবর্তী সংস্করণে এসকল অসঙ্গতি থাকবে না, এমনটাই আশা করি।
২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *