মুসা আল হাফিজের “তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব : ইসলামী উত্তরাধিকার” প্রকাশের এক সপ্তাহও হয়নি বোধ হয়। বায়তুল মোকাররমে বইমেলা চলছে, সে সুবাদে তাড়াতাড়িই বইটি সংগ্রহ করা হয়ে গেছে। এবং কিনে নিয়ে আসার পর এক বসায় পুরোটা পড়েও ফেলেছি।
বই পড়ে সেটা নিয়ে কিছু লেখার অভ্যাস আমার খুব একটা নেই, তবে মাঝেমধ্যে তার ব্যতিক্রম ঘটে। এটি সেরকম একটি বইই। পুরোটা পড়ে মনে হলো কী পড়লাম, সে সম্পর্কে কিছু একটা লিখলে মন্দ হয় না। ভূমিকা না বাড়িয়ে সরাসরি বইয়ের ভিতরেই ঢুকে পড়ি।
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নামক এই শাস্ত্রটির জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত নিবিড় পরিচর্যার কৃতিত্ব যে পুরোপুরি “আলেম-উলামার”ই, “তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব : ইসলামী উত্তরাধিকার” বইয়ে সে ধারণা পাওয়া যায়। সেই সাথে ইসলামি শিক্ষিতদের মধ্যে বর্তমানে এই শাস্ত্রের প্রতি যে অন্যায্য অমনযোগিতা, সেটাও এতে ফুটে উঠেছে।
পুরো বই পড়লে মনে হবে, এর অন্যতম উদ্দেশ্য সম্ভবত ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিতদেরকে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রতি আগ্রহী করে তোলা। বইটি রচনার প্রেক্ষাপটও অনেকটা তাই। মূলত এটি লেখকের এই বিষয়ক তিনটি বক্তৃতা অনুলিখন, যে সকল বক্তব্য তরুণ ইসলামি শিক্ষিতদের উদ্দেশ্যে উপস্থাপিত হয়েছিল।
আজকাল সাধারণ শিক্ষিত কিংবা ইসলামি শিক্ষিত নির্বিশেষে মোটামোটি সকলের ধারণা, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বোধ হয় ইউরোপীয়দের আবিষ্কৃত আরো অনেক শাস্ত্রের মতোই কোন এক শাস্ত্র, যার সাথে ইসলাম কিংবা মুসলমানদের, অন্তত ইসলামি পণ্ডিতদের কোন সম্পর্কই নেই। প্রথম অধ্যায়ে দুটি ঘটনা বর্ণনা করে এ বিষয়টিই তুলে ধরা হয়েছে। পরের অধ্যায়েও এই ইসলামি উত্তরাধিকার পাশ্চাত্যের দখলে চলে যাওয়ার বিষয়টি এসেছে।
তৃতীয় অধ্যায়ে মাদরাসার সিলেবাসে এ বিষয়টি গুরুত্ব না পাওয়া যে কত অযৌক্তিক, লেখক তা তুলে ধরেছেন। দেওবন্দের পাঠ্যক্রম অনুসরণের অজুহাতে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বকে কৌমি মাদ্রাসাসমূহের পাঠ্যক্রমের বাইরে রাখার সমালোচনা করে লেখক বলতে চেয়েছেন যে, দেওবন্দের পূর্বসূরীদের নিকটও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ছিল অবশ্য পাঠ্য, কাসিম নানুতুবীরা এসব পড়েই কাসিম নানুতুবী হয়েছিলেন।
তার পরের দুই অধ্যায়কে মোটামোটি “লিটারেচার রিভিউ” বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না বোধ হয়। পূর্ববর্তী আইম্মায়ে কেরাম এই শাস্ত্রে কত অমূল্য বই লিখে গেছেন, হাতে গোণা দু‘একটি বইর নাম জানা আমাদের জন্য তা আসলেই বিস্ময়কর। এমনকি নওমুসলিম পণ্ডিতদের অবদানও যে এক্ষেত্রে বিশাল, তার বর্ণনাও এসেছে মোটামোটি। ষষ্ঠ অধ্যায়ে বিবৃত হয়েছে পরবর্তী যুগে এই শাস্ত্রের পশ্চিমাদের দখলে চলে যাওয়ার কাহিনি।
এই পর্যন্ত বইটির প্রাথমিক আলোচনা কিংবা ভূমিকা পর্ব বলা যেতে পারে। এরপরের সবগুলো অধ্যায়ে মূলত কুরআন-হাদিসে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের বিষয়টি ঠিক কীভাবে এসেছে, সেই আলোচনা করা হয়েছে।
পবিত্র কুরআনের আয়াতে তুলনামূলক ধর্মতাত্ত্বিক উপায়ে আহলে কিতাবদেরকে দাওয়াত প্রদান, রাসূল (সা.)এর জীবনে বিভিন্ন সময়ে তিনি কীভাবে তুলনামূলক ধর্মতাত্ত্বিক উপায়ে দাওয়াতি কাজ পরিচালনা করেছেন, তারই নিজ হাতে গড়া ও প্রশিক্ষিত সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এ ধরনের দাওয়াতি কার্যক্রমে কত সুদক্ষ ছিলেন, চমৎকার ভাবে সেসব ফুটে উঠেছে।
বিশেষত বিভিন্ন খ্রিষ্টান রাজা-বাদশাহদেরকে দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে খ্রিষ্ট ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি নজর রেখে রাসূল (সা.) হৃদয়গ্রাহী যে চিঠিসমূহ লিখেছিলেন, লেখক এই বইয়ে তুলনামূলক ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেসব চিঠি সম্পর্কে চমৎকার আলোচনা করেছেন।
সেই সাথে তুলে ধরেছেন ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্কের কুরআনি পদ্ধতি, নিয়ে এসেছেন যুক্তি উপস্থাপনের মানতেকি নানা পদ্ধতির কথা। শেষের দিকে রাসূল (সা.) এর কতিপয় ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনাও স্থান পেয়েছে বইটিতে।
সামগ্রিকরূপে এই বইয়ে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের শাস্ত্রীয় আলোচনার চেয়ে বরং কুরআন-হাদিসের আলোকেই বিষয়টিকে উপস্থাপন করার প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব যে ইসলামি জ্ঞানেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ, বইয়ের পাতায় পাতায় সে বিষয়টি দৃঢ়ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ইসলামি শিক্ষিতদের জন্য, এবং ইসলামি চেতনাধারী অপরাপর সকলের জন্যও, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রথম পাঠ্যবই হিসেবে এই বইটি তাই তুলনাহীন।
……
……
এবার সংক্ষেপে অন্যদিকে একটু নজর দেওয়া যাক। ছাপা-মুদ্রণ-বাঁধাই সবকিছু মোটামোটি ভালোই হয়েছে। বানানে কিছু জায়গায় ভুল রয়ে গেছে, তবে প্রথম মুদ্রণ হিসেবে সেটা ধর্তব্য নয়। তাছাড়া আরবি প্রতিবর্ণায়নের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোন এক রীতি অনুসরণ করা হয়নি, এমনকি বিখ্যাত আরবি সাহিত্যিক আল-জাহিযের নাম লেখা হয়েছে আয যাহিয, তাতে কামারিয়া জিম বর্ণটা শামসিয়া যা/যাল/যোয়া বা এরকম কিছু একটা হয়ে গেছে (১৭ পৃ.)। তবে, এক বসায় পড়ে ফেলার মতো চমৎকার ঝরঝরে গদ্যে এরকম দুই-চারটি বানান চোখে পড়াই উচিত নয়! পরবর্তী সংস্করণে আশা করি বানানের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট যে কোন রীতি অনুসরণ করা হবে।
এবার সংক্ষেপে অন্যদিকে একটু নজর দেওয়া যাক। ছাপা-মুদ্রণ-বাঁধাই সবকিছু মোটামোটি ভালোই হয়েছে। বানানে কিছু জায়গায় ভুল রয়ে গেছে, তবে প্রথম মুদ্রণ হিসেবে সেটা ধর্তব্য নয়। তাছাড়া আরবি প্রতিবর্ণায়নের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোন এক রীতি অনুসরণ করা হয়নি, এমনকি বিখ্যাত আরবি সাহিত্যিক আল-জাহিযের নাম লেখা হয়েছে আয যাহিয, তাতে কামারিয়া জিম বর্ণটা শামসিয়া যা/যাল/যোয়া বা এরকম কিছু একটা হয়ে গেছে (১৭ পৃ.)। তবে, এক বসায় পড়ে ফেলার মতো চমৎকার ঝরঝরে গদ্যে এরকম দুই-চারটি বানান চোখে পড়াই উচিত নয়! পরবর্তী সংস্করণে আশা করি বানানের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট যে কোন রীতি অনুসরণ করা হবে।
পুরো বইয়ে যত সূত্র উল্লেখ করতে হয়েছে, প্রায় সবই মূল লেখার মাঝেই করা হয়েছে, এবং এই বইয়ের সাথে সেটা ভালোভাবেই যায়। তবে মাত্র পাঁচটি আয়াতে কারিমার সূত্র কেন পাদটীকায় দেওয়া হলো, আল্লা মালুম।
বই সম্পর্কে আলোচনায় এগুলো অবশ্য খুবই ছোটখাট বিষয়, এসবেবইয়ের বিষয়বস্তু কিংবা মানে কোন ঘাটতি হয় নাই। এখানে বইয়ের মূল বিষয়বস্তুর কেবল বর্ণনাই দেওয়া হয়েছে, সেই অর্থে কোন সমালোচনা করা হয় নাই। তার কারণ, বিষয়বস্তুর সমালোচনা করার মতো শাস্ত্রীয় অধিকারও আমার নাই। ফলে আমাকে এখানেই থামতে হচ্ছে।
এই লম্বা পুস্তক আলোচনা পড়েন বা না পড়েন (কারণ এটি পড়া খুব জরুরি কিছু নয়), বইটি পড়ার দাওয়াত রইলো।
…
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব : ইসলামী উত্তরাধিকার
মুসা আল হাফিজ
অনুলিখন: মাওলানা আরিফ বিল্লাহ
আমন্ত্রণ প্রকাশন
পরিবেশক: ইদরিসিয়া কুতুবখানা
অনলাইন পরিবেশক: রকমারি, নিয়ামা শপ, ওয়াফি লাইফ
মূদ্রিত মূল্য: ১৬০/- মাত্র
ক্রয় মূল্য: ৮০/- মাত্র (ইসলামি ফাউন্ডেশন আয়োজিত বইমেলা থেকে।)