বাংলাদেশের কালামবিরোধী শাইখগণের নিকট আরিফ আজাদ ও তার লেখালেখি বেশ জনপ্রিয়। তাঁর যুক্তিসমূহের শক্তি-দূর্বলতার কথা আপাতত এক পাশে সরিয়ে রেখে আমরা যদি তিনি কোন প্রেক্ষাপটে এমন লিখতে শুরু করেছিলেন, সে খবর নিতে যাই, তাহলে জানবো– মূলত নাস্তিকদের উত্থাপিত বিভিন্ন প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর দেওয়ার চেষ্টা থেকেই তার এসব লেখার প্রেক্ষাপট সূচিত হয়েছে। এবং কালাম শাস্ত্রের বৃহত্তর পরিমণ্ডলের মধ্যে তার এ লেখা সমূহও অন্তর্ভুক্ত। কারণ কালাম শাস্ত্রের মূল বিষয় হলো– কুরআন-সুন্নাহ থেকে আমরা যেসকল আকীদা অর্জন করেছি, সেগুলোকে কুরআন-সুন্নাহর বাইরের বিভিন্ন দলিল দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা। তার মানে দাঁড়ালো- পরিভাষা নিয়ে যাই বলি না কেন, প্রকৃত অর্থে কালাম শাস্ত্রকে মোটামুটি সবাই মেনে নিচ্ছি। আবার একই সাথে, কালাম শাস্ত্রের নামে যদি ভুল আকীদাকে প্রতিষ্ঠা করা হয়, তাহলে সেটার বিরোধিতা করছি। কোনটা ভুল, কোনটা শুদ্ধ– সেটি আপাতত একটু আলাপের বাইরে রেখেই বলছি, বিশুদ্ধ আকীদার পক্ষে কালাম শাস্ত্র বর্তমানে সকল পক্ষই গ্রহণ করছেন, কেউ কালাম শাস্ত্র পরিভাষাটিকে স্বীকার করে, কেউবা অস্বীকার করে। আজকের পরিস্থিতি আপনার চোখের সামনে, তাই আরিফ আজাদদের নব্য কালাম চর্চা আপনার নিকট দোষণীয় নয়, কিন্তু মাতুরিদি-আশয়ারি-রাযি-গাজালি-বাকেল্লানি রাহিমাহুমুল্লাহু আজমাঈন কোন পরিস্থিতিতে কালাম চর্চা করেছিলেন, সেটা হয়তো জানেন না বলেই সেই কালাম চর্চা নিয়ে এতো কথা বলছেন। আরিফ আজাদ যে পরিস্থিতিতে নব্য কালাম চর্চা করতেন, তার চেয়ে বহুগুণ জঘন্য পরিস্থিতি কালাম শাস্ত্রের মহান ইমামগণ ইসলামের মৌলিক আকীদার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। ২. আমাদের যে সকল শাইখ আজকাল তাওয়ীলের বিপক্ষে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন, তাদের সামনে وهو معكم আয়াতটি উপস্থাপন করলে ঠিকই তাওয়ীল করেন। তারা সাধারণত তাওয়ীল বাদ দিয়ে “প্রকৃত অর্থ” সাবিত করে “কাইফিয়্যাত” অজানা বলার যে নিয়মের কথা বলে থাকেন, উপরোক্ত আয়াতে, এবং এরকম আরো বহু আয়াতে, কিন্তু এই নিয়ম না মেনে ঠিকই তাওয়ীল করে বুঝিয়ে দেন। তারা বুঝিয়ে দেন, “চেয়ারম্যান সাহেব, আমরা আপনার সাথে আছি” বললে যেমন আসলেই দৈহিকভাবে সাথে সাথে থাকাকে বুঝানো হয় না, ঠিক তেমনি এ আয়াতেও সত্তাগতভাবে সর্বত্র থাকার কথা বুঝানো হয়নি। খুব সুন্দর কথা। কিন্তু এ কথার অর্থ দাঁড়ালো– তাঁরাও তাওয়ীল করেন, যেখানে তাদের মতানুসারে তাওয়ীল প্রয়োজন বলে মনে হয়, কেবল সেখানেই করেন আরকি। ৩. সালাফ কালাম চর্চার বিরুদ্ধে ছিলেন, তাওয়ীলেরও বিরুদ্ধে ছিলেন। এই সাদামাটা বাক্যের পক্ষে সোজাসাপ্টা বহু দলিল হাজির করা কঠিন কিছু না। কিন্তু উপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে কোন পক্ষই ইলমুল কালাম বা তাওয়ীল থেকে মুক্ত নন। সকলেই নিজেদের মতানুসারে বিশুদ্ধ আকীদার পক্ষের ইলমুল কালামকে সমর্থন করছেন, নিজেদের মতানুসারে বিশুদ্ধ তাওয়ীলকে সমর্থন করছেন। এই পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে দুটো পথ আছে। হয়তো বলতে হবে, সালাফের মতানুসারে সকলেই তাওয়ীল ও ইলমুল কালাম চর্চা করে গোমরাহ হয়ে গেছে, নয়তো স্বীকার করতে হবে, খালাফ যে তাওয়ীল ও কালাম চর্চা “ব্যাপক পরিসরে” (কারণ সালাফ থেকেও সীমিত তাওয়ীল পাওয়া যায়) শুরু করেছিলেন, মৌলিকভাবে তা নিষিদ্ধ নয়, যতক্ষণ না মৌলিক আকীদার বিরুদ্ধে চলে যায়। এই অনুসিদ্ধান্তে পৌছুতে পারলে তাওয়ীল-কালাম নিয়ে অর্ধেক বিতর্ক শেষ হয়ে যাবে। গণহারে তাওয়ীল-কালামের বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধ করতে হবে, নয়তো নিরেট তাফওয়ীদে ফিরে যেতে হবে। নিরেট তাফওয়ীদ করলে আশয়ারি-মাতুরিদিদেরও কোন অসুবিধা থাকবে না। ৪. এবার আসেন আশয়ারি-মাতুরিদিদের তাওয়ীল আসলে কোন উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। দেখবেন, বেশির ভাগ– বরং প্রায় সব– তাওয়ীল হয়ে থাকে আল্লাহকে স্থান-কাল থেকে পবিত্র এবং দেহ-অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তথা সাদৃশ্য থেকে পবিত্র প্রমাণ করার জন্য। তার মানে দাঁড়ালো মূল আকীদা হচ্ছে এই বিষয়ে। তাহলে আমাদের দেখতে হবে মৌলিকভাবে এই অবস্থান সালাফের নিকট গ্রহণযোগ্য কিনা। এটা দেখার প্রথম সূত্র অবশ্যই পবিত্র কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফ। কিন্তু কুরআন-হাদীসের সবকিছু যে সত্য সেটা মেনে নিয়ে তারপরের ব্যাখ্যাতেই তো সব মতপার্থক্যের সূচনা। ফলে আমাদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা যেটা করতে পারি, সেটা হলো সর্বজনসম্মত সালাফের আকীদার কোন কিতাবকে গ্রহণ করতে পারি। সে কিতাবে আমরা তাওয়ীল হয়তো পাবো না, কিন্তু আমাদের মূল যে আকীদা, অর্থাৎ আল্লাহ পাক স্থান-কাল-দিক-দেহ-অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-সাদৃশ্য থেকে পবিত্র কিনা, সেটা পাবো। এবং সেটাই মতপার্থক্যের মূল জায়গা। যদি দেখা যায়, স্থান-কাল-দিক-দেহ-অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-সাদৃশ্য সব কিছুকে সালাফ অস্বীকার করেছেন, তাহলে সে অনুযায়ী কালাম চর্চাকে গ্রহণযোগ্য বলবো, আর যদি দেখা যায়, সালাফ এসবের কোন কোনটি, যেমন- স্থান-দিক-অঙ্গ ইত্যাদি সাব্যস্ত করেছেন, তবে সে অনুযায়ী কালাম-তাওয়ীলকে গ্রহণযোগ্য বলে ধরে নেবো (যা কার্যত আমাদের কালামবিরোধী শাইখদের প্রকৃত অবস্থান, যেটা শাব্দিকভাবে তারা বলেন না যদিও)। ৫. সালাফের কোন কিতাবকে গ্রহণ করবো? আল ফিকহুল আকবার? কিন্তু এটি ইমাম আযম রাহিমাহুল্লাহ থেকে সাব্যস্ত কিনা, তা নিয়ে তো মতপার্থক্যের অবকাশ আছে। সর্বজনস্বীকৃত কোন কিতাব দরকার। আমরা দেখি, ঘরানা নির্বিশেষে এরকম গ্রহণযোগ্য কিতাব আছে কেবল ইমাম তাহাওয়ীর আকিদার কিতাব। এবার কোন ধরনের ব্যাখ্যা তাওয়ীল-ব্যতীত তাহাওয়ীর মূল ভাষ্যটি পড়ে দেখেন, তিনি কী লিখেছেন সেখানে? তিনি কি আল্লাহর জন্য পাঁচ দিক অস্বীকার করেছেন, নাকি ছয় দিকই অস্বীকার করেছেন? তাহাওয়ী যদি ছয় দিক অস্বীকার করেন, তবে আপনি তার রেফারেন্সে তো আর কোন এক দিক সাব্যস্ত করতে পারবেন না। হয়তো তাহাওয়ীভিন্ন আর কোন গ্রহণযোগ্য মতন বা মূলপাঠ নিয়ে আসেন, অথবা তাহাওয়ী যা বলেছেন, সেটা গ্রহণ করেন, নয়তো ঘোষণা দিন তাহাওয়ী আমাদের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। কথা সুস্পষ্ট। ইমাম তাহাওয়ী সুস্পষ্ট ভাষায় যা লিখেছেন, সেটার অপব্যাখ্যা অগ্রহণযোগ্য। আপনি যে আল্লাহকে কোন এক দিকে সাব্যস্ত করছেন, সেটার পক্ষে কেন সর্বজনস্বীকৃত সালাফের কোন কিতাব পাচ্ছেন না? যেহেতু পাচ্ছেনই না, ঘোষণা দিয়ে দিন, সালাফের কিতাবে আমার চলবে না, আমি পরবর্তীদের অনুসরণ করতে চাই, তাহলেই তো সব কিছুর সমাধান হয়ে যায়। আমরাও বুঝতে পারি, আপনি কি চাচ্ছেন। এবং আমাদের রাস্তা আলাদা হয়ে যায়।
My Personal Blog