সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে, সব ধরনের নির্বাচনী পূর্বাভাষ আর জনমত জরিপকে মিথ্যে প্রমাণ করে অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫ তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে বহুদূরে বসবাস করা এক ঝানু ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প। পপুলার ভোট কিছুটা কম পেলেও হিলারি ক্লিন্টনের চেয়ে অনেক বেশি ইলেক্টরাল ভোট পেয়েই তিনি এ বিজয় অর্জন করেন। তাঁর এ বিজয় নিয়ে সারাবিশ্বে চলছে আলোচনা সমালোচনা। বিশেষত নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালীন এবং এর আগের ট্রাম্পের অনেক কর্মকা- মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করার ফলে সাধারন মানুষের মনেও প্রশ্ন উঠছে এরকম একজন মানুষ কী করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হতে পারেন, যিনি কিনা কৌশলে কর ফাঁকি দিয়ে সেটা নিয়ে আবার গর্ব বোধ করেন, প্রকাশ্যে ভিন্ন সম্প্রদায়, ভিন্ন বর্ণ ও ভিন্ন লিঙ্গের মানুষ সম্পর্কে যাচ্ছেতা মন্তব্য করেন, প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীকে নির্বাচিত হয়ে জেলে ভরার ঘোষণা দেন।
আসলে বিস্ময়কর হলেও সত্যি, এসব বিষয় নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে ক্ষেত্রবিশেষ বরং ট্রাম্পের জন্যে ইতিবাচক প্রভাবই ফেলেছে। ট্রাম্পের মুসলিম বিদ্বেষ কিংবা কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্বেষের কথাই চিন্তা করুন। ট্রাম্প নিজেকে একজন তুখোড় সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালে। তাঁর এ প্রচারণার ফলে সারা বিশ্বের উদারপন্থী মানুষের ঘৃণা কুড়ালেও তিনি তাঁর মতলব ঠিকই হাসিল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কেননা আমেরিকার অধিকাংশ ভোটারই শ্বেতাঙ্গ খৃষ্টান। তাদের বেশির ভাগই মনে প্রাণে কৃষ্ণাঙ্গদের এবং মোসলমানদেরকে আমেরিকার শত্রু মনে করেন, তা তারা স্বীকার করুন কিংবা নাই করুন। তারা অভিভাসীদেরকেও তাদের শত্রু মনে করেন। ফলে এদের বিরুদ্ধে কথা বলে ট্রাম্প আসলে সিংহভাগ ভোটারের মনের কথাই খোলামেলা প্রকাশ্যে বলেছিলেন মাত্র, যা তাঁর ভোটের রাজনীতিতে অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ট্রাম্পের পূর্বসূরী বারাক ওবামা ২০০৮ সালে যখন রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, সে সময় সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল। সেই দুঃসময়ে মার্কিন মসনদে বসলেও গত আট বছরে ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অধোগতি রুখতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছেন। তা সত্ত্বেও অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গই প্রেসিডেন্ট ওবামার অর্থনৈতিক নীতির ব্যপারে সন্তুষ্ট হতে পারে নি, কেননা অনেক ক্ষেত্রেই ওবামার অর্থনৈতিক নীতির কারনে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি লাভবান হলেও শ্বেতাঙ্গরা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। রিপাব্লিকান ট্্রাম্প ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে এই বিষয়টি কাজে লাগান। তিনি বারবার বলতে থাকেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এই ধ্বংস থেকে রক্ষা পাওয়ার সুনির্দিষ্ট কোন পথ বাতলিয়ে না দিয়েই ট্রাম্প বলতে থাকেন, I can fix it আমিই ইহার সমাধান করতে পারি। আমজনতা সব দেশেই হুজুগে হয়ে থাকে। কাজেই মার্কিন শ্বেতাঙ্গরা ট্রাম্পের এই ফাঁকা বুলিতে বিশ্বাস করে ভাবতে থাকে, ট্রাম্পই তাদের স্বর্থ রক্ষা করতে পারবেন।
আরেকটি বিষয় অনেক বিশ্লেষকই সামনে নিয়ে আসছেন, তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত অনগ্রসর দেশ বাংলাদেশে বসে যেটি বিশ্বাস করতেও আমাদের কষ্ট হয়। সেটি হলো রক্ষণশীল মার্কিন শ্বেতাঙ্গ সমাজ আসলে এখনো একজন নারীকে দেশের শীর্ষ পদে দেখতে প্রস্তুত নয়। তাঁরা কৃষ্ণাঙ্গ ওবামাকে হোয়াইট হাউসে পাঠিয়ে দিতে রাজি ছিল, কিন্তু মহিলা হিলারিকে হোয়াইট হাউসে পাঠানেরা বিষয়টা পুরোপুরি মেনে নিতে পারে নি। নারী ক্ষমতায়নের বিষয়ে যত গালভরা কথাই তারা বলুক না কেন, বাস্তবে এ বিষয়ে তারা যে আমাদের চেয়েও পিছিয়ে, হিলারি পরাজিত হয়ে তা প্রমাণ করলেন।
এ ছাড়া তরুণ প্রজন্মের রাজনীতি বিরোধী মনোভাব থেকেও ফায়দা নিতে সক্ষম হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি নিজে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন। ফলে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের উপর বিরক্ত হয়ে অনেকে ট্রাম্পের পক্ষে চলে আসেন। আর ব্যবসায়ী ট্রাম্পের পক্ষে ব্যবসায়ীদের অবস্থান যে থাকবে, তা তো বলাই বাহুল্য। ফলে এ দিক থেকেও অনেক সুবিধা পেয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এ সব দিক বিবেচনা করে বলা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় আমাদের নিকট যতই দৃষ্টিকটু কিংবা অনাকাঙ্খিত হোক, আসলে এ বিজয় অপ্রত্যাশিত নয়। এ জয় বরং আধুনিক সভ্যতার ধারক বাহক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারন জনগনের চিন্তাচেতনারই প্রতিফলন। ট্রাম্প আমেরিকার শ্বেতাঙ্গদের মনের মতো কথা বলেছিলেন বলেই তারা ট্রাম্পকে বেছে নিয়েছে, তা তাঁর কথা কিংবা আচরণ যত উগ্র সাম্প্রদায়িক, বর্ণবাদী আর নারী বিদ্বেষী ই হোক না কেন। তবে এ সকল হুজুগে মার্কিনিদের জন্যে দুঃসংবাদ, ট্রাম্প মুখে যত বড় বড় কথাই বলে থাকুন না কেন, কাজের ক্ষেত্রে তাকেও সুনির্দিষ্ট পথ ধরেই এগুতে হবে। হয়তো হিলারির তুলনায় অনেক বেশি শ্বেতাঙ্গদের মনের মতো কাজ করার চেষ্টা তিনি করবেন, তাই বলে শ্বেতাঙ্গদের আশানুরূপ কিংবা খোদ ট্রাম্পের ঘোষনা অনুসারে ম্যাক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তৈরী করা কিংবা মোসলমানদের ব্যান করে ফেলা ট্রাম্পের পক্ষেও সম্ভব হবে না। মজার বিষয়, ইতোমধ্যে ট্রাম্পের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে মোসলমানদের ব্যান করার কথা মুছে ফেলা হয়েছে বলে বিশ্বমিডিয়ায় খবর প্রচারিত হয়েছে। তবে এতো কিছুর পরও ট্রাম্পের মতো আপাত অপ্রত্যাশিত রাষ্ট্রপতি শেষ পর্যন্ত বিশ্ব রাজনীতিতে কী ধরনের ভূমিকা রাখবেন, তা বুঝতে আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে বিশ্ববাসীকে। ইতঃপূর্বে তিনি যাই বলে থাকুন না কেন, দায়িত্বগ্রহনের পর তিনি দায়িত্বশীল আচরণ করবেন, বিশ্ববাসী তাই প্রত্যাশা করে।