জকিগঞ্জের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন: একটি পর্যালোচনা

যে কোন এলাকার প্রাচীন ইতিহাস জানার অন্যতম নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হলো সেই এলাকায় প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাবলি। জকিগঞ্জ এ অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন জনপদ। কাজেই প্রাচীন এই জনপদের ইতিহাস সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা অর্জনের জন্য এ এলাকায় প্রাপ্ত প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাবলি পর্যালোচনা করা একান্ত প্রয়োজন। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এ অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে যথাযথ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যাপ্ত গবেষণা এখনো হয় নি। তবু বিভিন্ন সময় এ জনপদ থেকে যে সকল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলোর ঐতিহাসিক মূল্যও খুব কম নয়। তন্মধ্যে কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং এগুলোর তাৎপর্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

ধর্মীয় সম্প্রীতির নিদর্শন: প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলের মানুষ ধর্মপ্রাণ ছিলেন, কিন্তু ধর্মের নামে সহিংসতায় বিশ্বাসী ছিলেন না, বরং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পারস্পরিক সহাবস্থানে বিশ্বাসী ছিলেন। এ ধারণার সমর্থন পাওয়া যায় জকিগঞ্জে প্রাপ্ত প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে। ১৯৫৪ সালে জকিগঞ্জের বারঠাকুরিতে মসজিদ নির্মাণের জন্য খনন শুরু করলে ৮ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট নকশী ইটের তৈরী দেওয়াল পাওয়া যায়। একই বছর স্থানীয় জনৈক মদরিছ আলী ৩ ফুট লম্বা ও ১ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট একটি শিলালিপি উদ্ধার করেন। শিলালিপিটির এক পৃষ্ঠায় আরবী ক্যালিওগ্রাফিতে মসজিদ সম্পর্কিত একটি হাদীস এবং অপর পৃষ্ঠায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধের প্রতিকৃতি অঙ্কিত ছিল। এই শিলালিপি থেকে প্রাচীন জকিগঞ্জের ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায়। বর্তমানে জকিগঞ্জে কোন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী না থাকলেও প্রাচীন জকিগঞ্জে যে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বসবাস ছিল, এই শিলালিপি থেকে তা ধারণা করা যায়। সম্ভবত মোসলমানদের আগমণের পূর্বে জকিগঞ্জে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অধিবাসীও ছিলেন, যারা পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন, কিংবা অন্যত্র চলে গেছেন। তবে মোসলমানদের আগমণের পর যত দিন তারা এ অঞ্চলে ছিলেন, তত দিন মোসলমানদের সাথে তাদের সম্প্রীতিমূলক সহাবস্থান ছিল, এ শিলালিপিটি তারই সাক্ষ্য বহন করে।

প্রাচীন মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন:জকিগঞ্জের বারহাল ইউনিয়নের খিলগ্রামে অবস্থিত নবাবী মসজিদ বা গয়বি মসজিদ জকিগঞ্জে প্রাপ্ত আরেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। স্থানীয় আলেমে দ্বীন মরহুম মাওলানা আরজত আলীর অনুমানের উপর নির্ভর করে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করে প্রায় শতাধিক বছর পূর্বে এ মসজিদটি পুনরোদ্ধার করা হয়। কিংবদন্তি মতে, এই মসজিদ সোনার তৈরি কলস এবং থুর দ্বারা সজ্জিত ছিল। মসজিদ পুনরোদ্ধার হওয়ার পর এ খবর পেয়ে জৈন্তার তৎকালীন রাজা সদলবলে হাজির হয়ে সোনার কলস এবং থুর নিয়ে যান। কিন্তু মসজিদের সোনার কলস ও থুর নিয়ে নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব হয় নি, পথিমধ্যে হস্তিবাহিনীসহ সুরমা নদীতে লুটেরা বাহিনী ডুবে যায়। পরবর্তীতে মসজিদে নামাজ আদায় শুরু হয় এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মসজিদটি আরো পরিবর্ধন করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, মসজিদ সংস্কারের সময় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহের প্রতি যথাযথ লক্ষ্য রাখা হয় নি। এ মসজিদটি জকিগঞ্জের প্রাচীন মুসলিম সভ্যতার অস্তিত্বের স্বীকৃতি প্রদান করে। প্রাচীন এ মসজিদের ভিতরের অংশ সোনার কলস ও থুর দ্বারা সজ্জিত থাকায় বোঝা যায়, এ এলাকায় প্রাচীনকালে অভিজাত মোসলমানদের বসবাস ছিল। তাদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা যথেষ্ট উন্নত ছিল কিংবা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এ মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। সর্বোপরি এ মসজিদটি প্রাচীনকালে এতদঞ্চলের মোসলমানদের সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্যের স্বাক্ষী বহন করে বললে অত্যুক্তি হবে না।

মুসলিম সুলতানদের নিদর্শন: জকিগঞ্জে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হলো সুলতানি আমলের রৌপ্য মুদ্রা।  পঞ্চদশ শতাব্দির দুই স্বাধীন মুসলিম সুলতান কর্তৃক জারিকৃত দুটি রৌপ্য মুদ্রা জকিগঞ্জের খলাছড়া ইউনিয়নের রাজুমিনার টিলায় পাওয়া যায়। সে যুগে শাসন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বর্তমান সময়ের মতো এতো উন্নত ছিল না, কাজেই অধিকাংশ শাসকের কর্তৃত্ব তাদের রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ থাকত। রাজধানীর বাইরে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চরগুলোতেই শুধু শাসকদের নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া মফস্বলে সে যুগে দ্রব্য বিনিময় প্রথাই প্রচলিত ছিল, কেন্দ্রীয় সরকারের জারিকৃত মুদ্রা সাধারণ মানুষ খুব একটা ব্যবহার করত না।  এ থেকে ধারণা করা যায়, এ অঞ্চল খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতকে বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
জকিগঞ্জে প্রাপ্ত এ সকল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে ধারণা করা যায়, মোসলমানদের আগমণের পূর্বে এ অঞ্চলে বৌদ্ধদের বসবাস ছিল। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে মোসলমানদের বসতি স্থাপিত হয়। অবশ্য এ অঞ্চলের মুসলিম সভ্যতাও যথেষ্ট প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী। যথাযথ পদ্ধতিতে অনুসন্ধান চালালে হয়তো এ অঞ্চলে আরো অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে।
তথ্যসূত্র:
    ১। জকিগঞ্জের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, মুহাম্মদ তাবারক হোসাইন।
    ২। প্রসঙ্গ জকিগঞ্জ ইতিহাস ও ঐতিহ্য, মো. হান্নান মিয়া (সম্পাদক)।

(সন্ধানীর ঈসালে সাওয়াব সংখ্যা-২০১৭ এর মূল পাতার মূল প্রবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *