সিলেটি উচ্চারণ

Syloti Pronunciation
[প্রেক্ষাপট: অনেক নন সিলেটি বন্ধু আমার সাথে সিলেটি ভাষায় কথা বলতে গিয়ে প্রশ্ন করে খিতা খররায়খিতাএর টাও তারা আরবী خ এর মতো উচ্চারণ করে (বেশির ভাগই আরবী পড়ুয়া, তাই খুব সুন্দর করে خ উচ্চারণ করে!), কেননা তারা সাধারণত জানে যে, সিলেটিরা কে আরবী خ এর মতো উচ্চারণ করে। কিন্তু কিতাযে আমরা বাংলার মতো করে উচ্চারণ করি, তা তো তাদের জানা নেই। তাদের সিলেটি উচ্চারণের এই দুর্দশা দেখেই মুলত সিলেটি উচ্চারণের কিছু নিয়ম-কানুন লেখার চিন্তা আমার মাথায় আসে। এই চিন্তা থেকেই নিচের নিয়মগুলোর অবতারণা।]
(কৈফিয়ত: আমি কোন ভাষাবিজ্ঞানী নই, কাজেই আমার এ লেখার একাডেমিক মূল্য যে খুব একটা নেই, তা আমিও মানি। তবু প্র্যাক্টিকাল অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কিছু কথা লিখলাম।)
* সিলেটিতে সাধারণত ‘, ‘বা এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন: কোন=কুন, চোখ=ছৌক, মোরে (আমাকে)= মরে।
* সিলেটি ঐ=অই (ওই নয়), এবং ঔ=অউ (ওউ নয়)
* ‘এবং বর্ণে /ঈ কার (ি/ী)অথবা /ঊ কার (ু/ূ)থাকলে কিংবা এদের পূর্বে /ঈঅথবা /ঊথাকলে তা বাংলা এর মতো উচ্চারিত হয়। (এই নিয়মেই কিতাউচ্চারিত হয়!)
* অন্যত্র উভয় বর্ণই সিলেটি খতথা অনেকটা আরবী خএর মতো উচ্চারিত হয়।
উদাহরণ: কিতাবা, তুমি কিলান আইলায়? যাউ‘, তুমি আওয়ায় কিলা কুশি অইছি, কাইয়া বুযাইতাম ফারতাম নায়। তুমার কুবর-উবর ফাই না, খান থা‘, ‘কিতা ? (আরে, তুমি কীভাবে এলে? যাক, তুমি আসাতে কতটা খুশি হয়েছি, তা বলে বুঝাতে পারব না। তোমার কোন খবর পাই না, এখন কোথায় থাক, কী কর?)
* সিলেটি ভাষায় পূর্ববঙ্গের বেশির ভাগ অঞ্চলের মতোই মহাপ্রাণ ধ্বনি নেই বলেলেই চলে। তবে মহাপ্রাণ ঘ, , , , , , , ভ প্রভৃতি বর্ণে কিছুটা Stress বা জোর দেওয়া হয়, যা দিয়ে এই বর্ণগুলোকে গ, , , , , , ব থেকে আলাদা করা যায়। তবে এই Stress বা জোর এতোই হালকা যে খুব সহজে তা বুঝা যায় না। তাই অনেকেই মনে করেন, মহাপ্রাণ বর্ণসমূহ অল্পপ্রাণের মতোই উচ্চারিত হয়।
উদাহরণ: গুড়া‘ (Powder) এর তে কোন Stress নেই, কিন্তু গুড়া‘ (Horse) এর তে হালকা Stress আছে।
* সিলেটিতে মহাপ্রাণের উচ্চারণ প্রায় নেই বললেই চলে, তবে কখনো কখনো দুএকটি মহাপ্রাণ ধ্বনির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
* ‘বর্ণটি সাধারণত ইংরেজি ‘S’ বা আরবী سএর মতো উচ্চারিত হয়।
* সাধারণত ‘ ‘এর মতো, ‘‘ ‘এর মতো, এবং ‘‘ ‘এর মত উচ্চারিত হয়। যেমন: পানি=ফানি, চাচা=ছাছা, কে=খে। তবে খ, , ফ এর উচ্চারণ সিলেটে ভিন্ন রকম, বাংলার মতো নয়। (এর ব্যতিক্রম উপরে আলোচনা হয়েছে।)
* , , য সাধারণত বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো উচ্চারিত হয়, যা অনেকটাই ইংরেজি ‘Z’ ও আরবী زএর মতো।
* সিলেটি আরবী فএবং ইংরেজি ‘F’ এর কাছাকাছি, বাংলা র মতো মহাপ্রাণ নয়।
পুনশ্চ: এই লেখা প্রায় শেষ করার পর অনেক দিন আমার মোবাইলের নোট অপশনে পড়ে ছিল। এই সময় মুহম্মদ আসাদ্দর আলীর লেখা ছিলোটি ভাষানামক মূল্যবান বইটি এবং সেই সাথে সৈয়দ মুজতবা আলীর সুলিখিত প্রবন্ধ সিলেটী‘ (বাংলা একাডেমির মাসিক পরিক্রমপত্রিকার মাঘ ১৩৬৯ সংখ্যায় প্রকাশিত) ও এই প্রবন্ধের উপর মুহম্মদ আব্দুল হাই এর আলোচনাআমার হাতে আসে। আসাদ্দর আলী সিলেটি ভাষার উপর যে আলোচনা করেছেন, সে তুলনায় আমার এই লেখা স্বভাবতই খুবই সামান্য। তারপরও আমি এই লেখায় তাঁর বই থেকে কোন তথ্য সংযোজন করিনি (যদিও উপরে বর্ণিত বেশির ভাগ সূত্রই বইটিতে রয়েছে, সেই সাথে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, সিলেটিতে কখন শুদ্ধ উচ্চারিত হয়, তার মোট ১৩ টি নিয়ম ছিলোটি ভাষাবইয়ে আছে।)
সৈয়দ মুজতবা আলী উপরে বর্ণিত Stress কে Tone বলা উচিৎ, না Accent বলা উচিৎ সে প্রশ্ন তুলেছেন, যদিও তাঁর পুরো লেখায় এটিকে Tonal জোর বলেই আখ্যায়িত করেছেন, আবার মুহম্মদ আব্দুল হাই Tone বা Accent কোনটাই এক্ষেত্রে যথার্থ পরিভাষা বলে মনে করেন নি। আমি তাদের লেখা পড়েও Stress শব্দটি আর পরিবর্তন করি নি, যদিও ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে Stress বলা যায় কি না, তা নিয়ে সংশয়ে পড়ে গেছি। যদি ভুল হয়, তবে দয়া করে উপরের কৈফিয়তপড়ে নিবেন। মুজতবা আলীর মতে, ঠ এবং থ বর্ণদ্বয় সিলেটিতে পুরোপুরি মহাপ্রাণরূপেই উচ্চারিত হয়, কিন্তু আমার কাছে তো সেরকম মনে হয় না। আমি বড় হয়ে অনেক কষ্ট করে মহাপ্রাণ ঠ এবং থ শিখেছি, অন্যান্য মহাপ্রাণ বর্ণের মতো। তারপরও সবসময় সঠিক উচ্চারণ করতে পারি না। অনুরূপভাবে আসাদ্দর আলী প্রমিত বাংলার মতো খ উচ্চারণের যে নিয়ম বর্ণনা করেছেন, সেগুলোও আমার কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট নয়।
পুনঃ পুনশ্চ: মূল কথার তুলনায় কৈফিয়ত, প্রেক্ষাপট আর পুনশ্চ এর অবস্থা বার হাত কাকুড়ের তের হাত বিচির মতো হয়ে গেছে। যাই হোক, কয়েকদিনের মধ্যে সিলেটি বর্ণমালা তথা নাগরি হরফ নিয়ে একটি পোস্ট দেওয়ার ইচ্ছা আছে, যা বছর দুয়েক আগে লিখেছিলাম। ভয় পাবেন না, সেটি এই লেখার মতো এতো লম্বা না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *