ছবি:সংগৃহীত |
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরের বাসিন্দারা সারা বছরে অন্তত ঈদের ছুটিটা গ্রামে কাটাতে চান, চিরচেনা সবুজ প্রকৃতিতে উৎসব উদ্যাপন করতে চান। আর তাই প্রতি বছর ঈদের মৌসুমে সড়ক, রেল ও নৌপথে শুরু হয় ঈদযাত্রা। এ যাত্রায় থাকে উৎসবের আমেজ আর শেকড়ের প্রতি মানুষের সহজাত টান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এ আনন্দযাত্রা মোটেও নিরাপদে নির্বিঘেœ হয় না, বরং প্রতি পদে পদে পোহাতে হয় অনেক ঝামেলা। সব ঝামেলা মানুষ মেনেও নেয় হাসি মুখে, কিন্তু তাই বলে প্রাণের শংকাও কি মেনে নিতে হবে?
প্রতিবছরই অসংখ্য মানুষ ঈদযাত্রায় প্রাণ হারান, আরও অনেকে আহত হন, স্বজনহারা হন, এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয় নি। বিষয়টা এমন নয় যে, সারা বছর মানুষ নিরাপদ পরিবহন সুবিধা পান, শুধু ঈদের মৌসুমে একটু বিপত্তি ঘটে। বরং বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশে কখনোই নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না, তবে ঈদের মৌসুমে এ অনিশ্চয়তা আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়।
এবারের পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি ‘ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনার প্রতিবেদন-২০১৭’ প্রণয়ন করে, যা গত পাঁচ জুলাই বিভিন্ন পত্রিকা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে এবারের ঈদ উপলক্ষ্যে সড়ক, রেল ও নৌপথে মোট ৩১১ জন ঈদযাত্রী মৃত্যুবরণ করেছেন, আহত হয়েছেন আরও ৮৬২ জন। দুর্ঘটনার শিকার এসকল মানুষের এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের এবারের ঈদ উৎসব যে বিষাদে পরিণত হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য এ হিসাবের বাইরে আরও অনেক আহত-নিহত থাকতে পারেন, কেননা এ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে ২২টি জাতীয় দৈনিক, ৬টি আঞ্চলিক দৈনিক এবং ১০ টি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের উপর ভিত্তি করে। এর বাইরে আরও অনেক দুর্ঘটনাই হয়তো ঘটেছে যেগুলো এসকল সংবাদ মাধ্যমে আসে নি।
কিন্তু আমরা যদি এই হিসাবটাকে সঠিকও ধরে নেই, তাহলে এই হিসাবও কি যথেষ্ট ভীতিকর নয়? প্রতি বছরই এরকম শত শত মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন পরিবহন দুর্ঘটনায়। দুর্ঘটনার সংখ্যা কমছে না, কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এসব দুর্ঘটনা। কাজেই এ বিষয়টিকে মোটেও হালকা করে দেখার সুযোগ নেই।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আমাদের দেশের গাড়িচালক, পথচারী কিংবা যাত্রী কেউই নিয়মের ধার ধারতে চান না। সবাই কোন মতে নিজের সুবিধাটুকু আদায় করতে ব্যস্ত থাকেন। নিয়ম মেনে পথচলার ট্র্যাডিশনই এখনো আমাদের দেশে তৈরি হয় নি, তাই কোন একজন চালক কিংবা পথচারী নিয়ম মেনে চলতে চাইলে উল্টো তাকেই বিপদে পড়তে হয়। এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈনি খুবই দরকার। প্রয়োজনে গাড়ি চালকদের পাশাপাশি পথচারিদেরও শাস্তি-জরিমানার আওতায় আনা যেতে পারে, তবে এক্ষেত্রে আগে ট্রাফিক পুলিশের নামে প্রচলিত দুর্নামগুলো মুছতে হবে।
আমাদের দেশে আরেকটি সমস্যা হলো পরিবহন শ্রমিকদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয় না। এ কথা সত্যি, বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া কোন চালকই ইচ্ছা করে কোন দুর্ঘটনা ঘটান না। তবু এ কথাও তো স্বীকার করতে হবে, প্রায় ক্ষেত্রেই চালকের অযোগ্যতা, অমনযোগিতা কিংবা অসচেতনতা দায়ি হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে অযোগ্য চালক কীভাবে গাড়ি চালানোর সুযোগ পেল, সেটা যেমন খতিয়ে দেখে প্রয়োজনে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার, তেমনি চালকের অসচেতনতা প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া একান্ত আবশ্যক। কোন প্রভাবশালী শ্রমিক নেতা বা এ ধরণের কারো সহযোগিতায় এসকল দোষী ব্যক্তিরা পার পেয়ে গেলে চালকদের অসচেতনতা আরো বৃদ্ধি পাবে। ফলে সবারই, এমনকি যে বা যারা অপরাধীদের বাঁচাবেন, তাদেরও জীবনের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
ইত্তেফাক: তারুণ্যের সমকালীন ভাবনা, ১২ জুলাই, ২০১৭।