যুক্তরাজ্যের রাজনীতি দীর্ঘ দিন ধরে ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে ঘোরপাক খাচ্ছে। ব্রেক্সিট হবে কিনা, হলে কীভাবে হবে, কখন হবে, চুক্তিতে কী থাকবে, কী থাকবে না, নাকি আদৌ কোন চুক্তিই হবে না, এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজতে খোঁজতে বাঘা বাঘা সব রাজনীতিবিদ হয়রান হয়ে পড়েছেন। সর্বশেষ থেরেসা মে তাঁর পছন্দ মতো ব্রেক্সিট চুক্তি সংসদে পাশ করাতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষমতা থেকেই ছিটকে পড়েন। অনেকটা প্রত্যাশিতভাবেই এরপর প্রধানমন্ত্রী হন বরিস জনসন, যাকে কিনা অনেকে যুক্তরাজ্যের ট্রাম্প বলে আখ্যায়িত করে থাকেন।
জনসনের অন্যতম প্রতিশ্রুতি হলো যে কোন উপায়ে ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন। তিনি প্রয়োজনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে কোন ধরনের চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিট করতে প্রস্তুত। অথচ এরকম চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট উভয় পক্ষকে কত ধরনের বিপদে ফেলতে পারে, তা কারোরই অজানা নয়। সকলের আশা ছিল, সংসদ জনসনকে এ ধরনের খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন থেকে আটকিয়ে রাখবে। জনসন নিজেও বিষয়টি বুঝতে পেরে সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখ থেকে ১৪ অক্টোবর অবধি সংসদ স্থগিত রাখার প্রস্তাব রাণিকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন। এই মুহূর্তে সংসদ সদস্যরা গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপন করছেন, অবকাশ যাপন শেষে তারা সংসদে ফিরবেন সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ, এরপর স্থগিতের আগে সংসদ চলবে মাত্র সপ্তাহ খানেক।
বর্তমানে ব্রেক্সিটের জন্য নির্ধারিত তারিখ হলো ৩১ অক্টোবর। ফলে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের পূর্ব পর্যন্ত সংসদ যাতে বড় ধরনের কোন বাধা সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্যই বরিস জনসন সংসদ স্থগিতের এই চাল চেলেছেন। বিরোধীরা স্বভাবতই এই চালের তীব্র বিরোধিতা করছেন। কিন্তু এই বিরোধিতাকে কার্যকর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে খুব সহজ হবে না।
সংসদ স্থগিতের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সাংসদদের সামনে এখন মাত্র দুটো পথ খোলা আছে। হয়তো জনসনকে তাঁর ইচ্ছা মতো ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের সুযোগ দিয়ে দিতে হবে, তিনি ৩১ অক্টোবর ঠিকই ইউনিয়ন ত্যাগ করবেন, তা চুক্তি হোক কিংবা নাই হোক। সাংসদদের সামনে থাকা অপর পথটি হচ্ছে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ শেষে কালক্ষেপণ না করে তাৎক্ষণিক জনসনকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নতুন তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করা। এই পথটি অবশ্য খুব সহজ নয়।
নতুন তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে হলে প্রথমে সংসদে বরিস জনসনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাশ করাতে হবে। এটি অবশ্য খুব কঠিন হবে না, কারণ খোদ জনসনের রক্ষণশীল দলেই “চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট বিরোধী” সংসদ সদস্যদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। কিন্তু শুধু এর মাধ্যমেই জনসনকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা সম্ভব নয়। বরং ব্রিটেনের সংসদীয় আইন অনুসারে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব সংসদে পাশ হলে অবশ্যই পরবর্তী ১৪ দিনের মধ্যে নতুন তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করতে হবে। সংসদ এটি করতে ব্যর্থ হলে অনাস্থা প্রস্তাবে পরাজিত ব্যক্তিই প্রধানমন্ত্রী পদে থাকবেন, এবং পরবরর্তী ৩ মাসের মধ্যে তিনি নির্বাচনের আয়োজন করবেন।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, আইনত ১৪ দিন সময় থাকলেও বাস্তবে ব্রিটিশ সংসদের হাতে সময় থাকবে মাত্র এক সপ্তাহ। কারণ গ্রীষ্মকালীন অবকাশের পর সংসদ চালু হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই আবার সংসদ স্থগিত হয়ে যাবে। এই এক সপ্তাহের মধ্যে বরিস জনসনের স্থানে অন্য কাউকে নির্বাচন করা সম্ভব না হলে জনসন পুরো তিন মাস সময় পেয়ে যাবেন, ৩১ অক্টোবরে ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করার জন্য এই সময়টুকু যথেষ্টেরও বেশি।
প্রশ্ন হলো তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করা কতটুকু সহজ? বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা জেরেমি কর্বিন তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রস্তুত আছেন। তিনি শুধুমাত্র বেক্সিটের সময়সীমা বৃদ্ধি ও পুনরায় নির্বাচন আয়োজন করার দায়িত্ব নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হতে চান। কিন্তু সমস্যা হলো “চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট বিরোধী” সংসদ সদস্যদের মধ্যে অনেকেই, বিশেষত রক্ষণশীল দলের সংসদ সদস্যরা তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মানতে চাইবেন না। আর তাই অনাস্থা প্রস্তাব পাশ হলেও কর্বিন প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, বরিস জনসনকে ক্ষমতাচ্যূত করাও তাই সহজ হবে না। কাজেই কর্বিনের বদলে তুলনামূলক নিরপেক্ষ এমন কোন প্রার্থী খোঁজে বের করতে হবে, যাঁর প্রতি “চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট বিরোধী” সকল সংসদ সদস্যের আস্থা রয়েছে। এবং এসব কিছুই করতে হবে আগামী ৩ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর, এই এক সপ্তাহের মধ্যে।
সে যাই হোক, যুক্তরাজ্যের রাজনীতির বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় জনসনকে সরিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করা নেহায়েত সহজ কাজ হবে না। এই পরিস্থিতিতে আগামী ৩১ অক্টোবর চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিটের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, কারণ জনসন যে কোন উপায়ে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
[ঈষৎ সম্পাদিত আকারে ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখের যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত।]